‘চাচিকে নিয়ে গত সপ্তাহে এখানে এসেছিলাম দুপুর ১২টার একটু পরে। তখনও লাইনে লোক ছিল, টিকিট বিক্রি হচ্ছিল। কিন্তু পৌনে ১টার দিকে হঠাৎ দেখি কাউন্টার বন্ধ। ভেতরের চেয়ার ফাঁকা। অনেক খোঁজাখুঁজি করে টিকিট বিক্রেতাকে বাইরে পাওয়া গেলো। কিন্তু অনেক অনুরোধ করেও তাকে আর কাউন্টারে বসাতে পারলাম না। আজ (বৃহস্পতিবার) তিনদিন পর আবার এসে টিকিট কাটতে পেরেছি’— বলছিলেন ১৭ বছরের মিনহাজ। তার কথায়, ‘সরকারি হাসপাতালে মূলত দরিদ্ররাই আসেন। অথচ কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের কোনও গুরুত্বই নেই। ১০ টাকার টিকিট কেটে মানুষ যেন ভোগান্তি আর দুর্ভোগ কেনে।’
কেবল মিনহাজ একা নন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাবুরও একই অভিযোগ। তিনি বলেন, ‘একই প্রসঙ্গ ধরে বাবু বললেন, ‘এখানে সকাল ৮টায় এসে সিরিয়াল দিতে হয়, ডাক্তার আসেন ৯টায়। অথচ তিনি চলে যান সাড়ে ১২টার পরপরই। আবার যাদের নিজেদের লোক আছে এখানে তারা সিরিয়াল না দিয়েও ডাক্তারের চেম্বারে যেতে পারেন আগে। এখানে নিজের লোক না থাকলে কাজ হয় না। যাদের কেউ থাকে না তারা যে কত ভোগান্তিতে পড়েন তা বর্ণনাতীত।’
বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গত কয়েক বছরের তুলনায় এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও সেবাদানের ক্ষেত্রে ভোগান্তি রয়েই গেছে।
এদিন সকাল ১১টায় পঙ্গু হাসপাতালে পুরাতন জরুরি বিভাগের সামনে দুর্ঘটনায় আহত ছেলেকে নিয়ে নোয়াখালী থেকে এসেছেন তমিজউদ্দীন ও তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম। তমিজউদ্দীনের ডান হাতে মাদুর, বাঁ-হাতের দুটি বালিশ ও একটি ব্যাগ। রোকেয়ার হাতে আরও দুটি বড় ব্যাগ। তবে ছেলেকে সিএনজি থেকে নামাতে না পেরে তারা এদিক-ওদিক করছেন। অবশেষে একটি হুইলচেয়ার নিয়ে আসেন হাসপাতালের একজন। তাকে চেয়ারে বসিয়েই দ্রুত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ওদিকে তমিজউদ্দীন ও রোকেয়া ছুটছেন। একসময় তারা আর পেরে উঠলেন না। পুরাতন হাসপাতাল এবং নতুন জরুরি বিভাগের ভেতরের রাস্তায় খেই হারিয়ে ফেললেন।
ছেলে চোখের আড়াল হওয়ায় মাঝপথেই থমকে যান তমিজউদ্দীন ও রোকেয়া দম্পতি। যাকেই পাচ্ছেন তার কাছেই তারা জানতে চাইছেন, ‘ছেলেকে নিয়ে কোথায় গেলো হাসপাতালের লোক?’ তমিজউদ্দীন এ প্রতিবেদককে বললেন, ‘পোলাডারে নিয়া কই গেলো? তারে তো খুঁইজে পাইতেছি না। এ কেমন হাসপাতালে এলাম, কেউ কিচ্ছু কবার পারি না।’
তমিজউদ্দীনের অবস্থা দেখে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন বলেন, ‘এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগ বদলেছে। নতুন ভবনটি যারা চেনেন না কিংবা যারা গ্রাম থেকে আসেন তাদের জন্য এই অলিগলি পেরিয়ে নতুন বিভাগে যাওয়া খুব কষ্টের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এত টাকা খরচ করে নতুন বিভাগ করলো, অথচ সেখানে যেতে একটা তীর চিহ্ন দিয়ে রাখলেই মানুষের ভোগান্তি কমে যেত।’
নতুন জরুরি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, হাত-পা মচকে গেছে কিংবা ভেঙে গেছে এমন রোগীদের নিয়ে স্বজনরা বসে আছেন। এখানে দালালদের দৌরাত্ম্য লক্ষণীয়। নতুন কোনও রোগী এলেই তাকে ঘিরে ধরছেন তারা। ‘সব ট্রলি কিংবা হুইলচেয়ার থাকে দালালদের দখলে। তাদের এড়িয়ে কিছুই করা যায় না এখানে’— বলেছেন মিনহাজ।
এদিকে নতুন জরুরি বিভাগ করলেও সেখানে থাকা হুইলচেয়ার ও টানা চেয়ারগুলোর বেহাল দশা নজরে পড়েছে সবার। হুইলচেয়ার বাঁধা রশি দিয়ে, এছাড়া টানা চেয়ারগুলোতে বসতে গেলেই হেলে পড়ে পেছনের দিকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক আবদুল গণি মোল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এসব অভিযোগ নিয়ে টেলিফোনে কথা বলা যাবে না। হাসপাতালে আসেন। তখন সব বিষয়ে আলোচনা হবে।’
/জেএ/জেএইচ/