X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১
উখিয়া টু বালুখালি

ত্রাণের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা

নুরুজ্জামান লাবু, কক্সবাজার (উখিয়া) থেকে
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৫৮আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৩

ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গারা রাত ৮টা, চারিদিকে অন্ধকার। দূরে স্থানীয় বাসিন্দা আর রোহিঙ্গাদের নতুন-পুরনো ক্যাম্পগুলোয় মিটি মিটি আলো জ্বলছে। মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছে ছোটবড় গাড়ি ছুটে যেতে। এর মধ্যে চোখে পড়লো রাস্তার পাশে নারী, পুরুষ ও শিশুদের ছোট ছোট জটলা। কেউ দাঁড়িয়ে, আবার কেউ বসে আছে। সবাই বসে আছে ত্রাণের অপেক্ষায়। ট্রাক দেখলেই ছুটে যায়, যদি ত্রাণ মেলে। সোমবার বিকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দেখা গেলো এই চিত্র।

কুতুপালং আর বালুখালি মাঝামাঝি রাস্তায় একটা জটলার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখা মিললো কয়েকজন নারীর। এদের একজন রাশিদা।বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। স্বামী নজির আহমেদের কোনও খোঁজ জানেন না। তিন দিন আগে তমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু থাকার কোনও জায়গা পাচ্ছেন না। খাবারের ব্যবস্থাও নেই। স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে প্রথম তিন দিন থেকেছেন। সোমবার খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছেন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন যদি কেউ কিছু দিয়ে সহযোগিতা করে।

রাশিদা জানান, তাদের বাড়ি রাখাইনের বালি বাজার এলাকায়। বাড়িতে গরু ছিল, জমি-জমাও ছিল। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সুখের সংসারও ছিল। কিন্তু এক নিমিষেই সব তছনছ হয়ে গেল। স্বামী-সন্তানদের কোনও খোঁজ নেই।প্রতিবেশীদের সঙ্গে জীবন নিয়ে কোনও রকমে পালিয়ে এসেছেন।তার আশা,স্বামী-সন্তানরা কোথাও না কোথাও আশ্রয় নিয়ে আছেন।

ত্রাণের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা

রাশিদার মতো ত্রাণের অপেক্ষায় ছিল কিশোরী ইয়ারুন্নেছা। স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছে সে। চার দিন আগে তমব্রু দিয়ে এসেছিল তারা। কিন্তু স্বামী আজিজের কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না। ছোটবেলায় বাবা-মা হারানো ইয়ারুন্নেছা বড় হয়েছেন চাচাদের কাছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় সেই চাচাদের কাছেও যেতে পারেননি।

ইয়ারুন্নেছা বলেন, ‘সকালে গুড়-মুড়ি পেয়েছিলাম। দুপুরে চিড়া।তাই খেয়েছি। রাতের খাবারের কোনও ব্যবস্থা হয়নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, যদি কোনও সহযোগিতা পাই। তবেই রাতের খাবার জুটবে।’

বিকালে একজন ৪০টা টাকা দিয়েছে।তা সংগ্রহ করতে গিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে।এতে হাত কেটে রক্তও বেরিয়েছে। হাতের সেই জমাটবাধা রক্ত দেখিয়ে ইয়ারুন্নেছা বলেন,‘কোনও ত্রাণ না পেলে এই ৪০ টাকা দিয়ে রাতের খাবার কিনে সবাই ভাগ করে খাবো।’

ত্রাণের অপেক্ষায় থাকা ইয়াসমিন

১৫ বছরের ইয়াসমিনও ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিল। তার কাছে বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে।  মা ও ভাই হারানোর সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সে বলে, ১০-১২ দিন আগের কথা। তাদের বাড়িতে মগরা যখন আক্রমণ করেছিল তখন বাবা কুইল্যা মিয়া, ছোট দুই বোন তাসমিন আরা ও সুমা আর ভাই সুমনকে নিয়ে বাড়ির পেছনের দিক দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল সে। বাড়িতে ছিল তার মা জোহরা খাতুন আর বড় ভাই ফারুক। মগরা তাদের সামনেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার তার মা ও ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মাথা কেটে কাটা মণ্ডু দূর থেকে তাদের দেখায়।এরপর তারা চলে আসে তমব্রু সীমান্তে। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর সীমানা পেরিয়ে এসেছে কুতুপালং পুরনো ক্যাম্পের খালার বাসায়। বছরখানেক আগে খালা তার পরিবার নিয়ে চলে এসেছিল বাংলাদেশে। ইয়াসমিনের ভাষ্যমতে, তার বাবা চোখে দেখেন না। বড় ভাই ফারুক আর মা ছিল সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জমিতে চাষ করে বড় ভাই আর মা তাদের সংসার চালাতো। মা আর ভাইয়ের মৃত্যু তাদের একেবারেই অবলম্বনহীন করেছে।

কাঁদতে কাঁদতে ইয়াসমিন বলছিল, ‘ছোট ভাইবোন আর অন্ধ বাবাকে খালার বাসায় রেখে বেরিয়েছি খাবারের সন্ধানে। কারণ খালাও যে আশ্রয়হীন, ক্যাম্পে কোনোরকমে খেয়ে না খেয়ে জীবন কাটায়। সে এতগুলো মুখের আহার যোগাবে কিভাবে?’

নতুনদের সঙ্গে ত্রাণের আশায় পুরনোরাও: নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কক্সবাজারে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারা মিশে ত্রাণ নিচ্ছে। বিকালে এই প্রতিবেদক যখন উখিয়া থেকে বালুখালির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন রাস্তায় মাঝে মধ্যেই রোহ্ঙ্গিাদের বসে থাকতে দেখে সিএনজি চালক আব্দুর রহিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,নতুন-পুরনো রোহিঙ্গরা ত্রাণের আশায় বসে আছে।

পুরনো রোহিঙ্গাদের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় এই ব্যক্তি বলেন, ‘পুরনোদের মধ্যে যারা গরিব তারা নতুনদের সঙ্গে মিশেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু সহযোগিতা পেলে খারাপ কি? মাঝে মধ্যে ত্রাণের ট্রাকগুলো থামিয়ে নানারকমের খাবার আর অন্যান্য জিনিসপত্র ছুঁড়ে দেয়,তাই কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যায় ওরা।’

উখিয়া-বালুখালির রাস্তা

সোমবার বিকালে এই প্রতিবেদক কুতুপালং এলাকায় খবর সংগ্রহের সময় অনেক নারী ও শিশুদের মানুষের কাছে সহযোগিতা চাইতে দেখেছেন। যাদের বেশিরভাগই পুরানো ক্যাম্পের রোহিঙ্গা বলে বলছিলেন স্থানীয়রা।

রেজিস্ট্রেশনের জন্য সাড়া কম: রোহিঙ্গাদের নাম নিবন্ধন করে পদ্ধতি অনুসারে ত্রাণ বিতরণের কথা বলা হলেও অনেকেই বিষয়টি জানেনই না। আবার অনেকের নাম নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আগ্রহও নেই।

রহিমা খাতুন নামে পাঁচ সন্তানের জননী বলেন, তিনি দুদিন আগে এসেছেন। কোথায় নাম নিবন্ধন করে তার জানা নেই। যেখানে রাত হচ্ছে তিনি সেখানেই কাটাচ্ছেন। আর চেয়ে-চিন্তে কোনোরকমে দিন পার করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,সোমবার রাত পর্যন্ত মাত্র ১৯ হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা তাদের নাম নিবন্ধন করেছেন।

পাসপোর্ট অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আজিজ আহমেদ জানান, তারা সব রোহিঙ্গাদের নাম নিবন্ধনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। এজন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন:

স্বজনদের লাশ শনাক্তে মিয়ানমারে ফিরতে চায় রোহিঙ্গা হিন্দুরা

বিধবা হিন্দু রোহিঙ্গা নারীরা বললেন নির্যাতনের কথা

মুসলিম নারীদের সঙ্গে বোরকা পরে পালিয়ে এসেছেন পূজা

/এনএল/এসটি/
সম্পর্কিত
১২ ঘণ্টার মাথায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরেক যুবককে হত্যা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে হত্যা
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে থাইল্যান্ড সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
সব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি হারুনসব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী