X
রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
১৫ আষাঢ় ১৪৩২

শান্তিচুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৪টির: জেএসএস

সঞ্চিতা সীতু
০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:২৬আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ২১:৩৬


১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণ (ফাইল ছবি)
রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের আশায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে জনসংহতি সমিতি ( জেএসএস)। কিন্তু, দুই দশক পরেও তাদের অভিযোগ, মূল চুক্তির ১৯টি ধারায় বর্ণিত ৩৭টি মৌলিক বিষয়ের মধ্যে মাত্র ৪টির পূর্ণ বাস্তবায়ন করেছে সরকার। আর ৯টি মৌলিক বিষয়ের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা কাজ এগিয়েছে। কিন্তু বাকি প্রায় ২৪টির কোনও কাজই হয়নি। শান্তিচুক্তির দুই দশক পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়েছে।
তবে সংগঠনটির দাবি নাকচ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শান্তিচুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে।
জনসংহতি সমিতি তাদের চুক্তির বিষয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, চারটি ভাগে বিন্যস্ত শান্তিচুক্তির ধারা ক. এ মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যেই প্রথমেই আছে উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ, বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন। এরমধ্যে কমিটি গঠনের বিষয়টি আংশিক বাস্তবায়িত হলেও বাকি বিষয়গুলো অবাস্তবায়িতও রয়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, উপজাতিদের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল বিভিন্ন ভাষা-ভাষী উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বিবেচনা করে সংবিধিবদ্ধ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, সংবিধানে ২৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদে ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে বা নাগরিকদের অনগ্রসর অংশের’ পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনগ্রসর পাহাড়িদের শব্দগুলো সংযোজন করা এবং  ৮০-র দশকের পুনর্বাসিত সেটেলারদেরকে সমতল জেলাগুলোতে পুনর্বাসন করার জন্য পরিকল্পনা ও  বাস্তবায়ন করা জরুরি। কিন্তু এর কোনোটিই বাস্তবায়নে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি সরকার। আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিষদ সুপারিশমালা উপস্থাপন করলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ইনি সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হলেও এই কমিটির নিজস্ব কোনও কার্যালয় নেই, নেই কোনও জনবল। ফলে এই কমিটি অকার্যকর অবস্থায়ই আছে।

শান্তিচুক্তির দুই দশক পূর্তিতে এক প্রতিবেদনে এসব দাবি করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি
মূল ধারা খ এ বলা আছে, অ-উপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা নির্ধারণ, অউপজাতীয় সার্টিফিকেট দেওয়া, ভোটার হওয়ার যোগ্যতা ও ভোটার তালিকা করা, পরিষদের কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ, উন্নয়ন পরিকল্পনা, জেলা পুলিশ এবং আইন-শৃঙ্খলার সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধান, ভূমি সংক্রান্ত বিশেষ বিধান, ভূমি উন্নয়ন কর আদায়, পরিষদের বিশেষ অধিকার এবং পরিষদের আওতাধীন বিষয়গুলো ও তাদের হস্তান্তর। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এরমধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও সবই চলছে সরকারের মর্জিমাফিক। এর বাইরে সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়ে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করা হয়েছে জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে। মৌলিক অন্য বিষয়গুলোও বাস্তবায়ন হয়নি ।
ধারা গ এ আছে-আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করা, পৌরসভারসহ স্থানীয় পরিষদগুলো তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করা, সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাসহ এনজিও কার্যক্রম সমন্বয় করা, উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় করা, ভারি শিল্প স্থাপনের লাইসেন্স দেওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ওপর সাধারণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধান, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ও অন্য আইনের অসঙ্গতি দূর করা এবং আইন প্রণয়নে আঞ্চলিক পরিষদের প্রাধিকার প্রদান। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এইগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়েছে। আর কোনোটি বাস্তবায়ন হয়নি।
ধারা ঘ এ আছে-উপজাতীয় শরণার্থী পুনর্বাসন, আভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, ভূমিহীনদের ভূমি বন্দোবস্ত করা, ভূমি কমিশন ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি, রাবার চাষ ও অন্য কোনও ধরনের চাষের জন্য বরাদ্দকৃত জমির ইজারা বাতিল করা এবং উন্নয়ন লক্ষ্যে অর্থ বরাদ্দ ও পর্যটন সম্পর্কে উৎসাহ দেওয়া, কোটা সংরক্ষণ ও বৃত্তি দেওয়া, উপজাতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা, জনসংহতি সমিতির সদস্যদের অস্ত্র জমাদান, সাধারণ ক্ষমতা ও মামলা প্রত্যাহার, জনসংহতি সমিতির সদস্যদের ঋণ মওকুফ, চাকরিতে পুনর্বহাল ও পুনর্বাসন, সব অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও পরিত্যক্ত জায়গা জমি হস্তান্তর,সব ধরনের চাকরিতে উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন। প্রতিবেদনে জানানো হয়, এরমধ্যে অস্ত্র জমা ও মন্ত্রণালয় করার কাজটিই সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এছাড়া শরণার্থী পুনর্বাসন ও পর্যটনের বিষয়ে কিছু কাজ করেছে সরকার। শরণার্থী পুনর্বাসনের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার।
শান্তিচুক্তির মূল ধারাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে ভূমি বিরোধ সংক্রান্ত ধারাগুলো। জনসংহতির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও তাতে নেই জনবল, নেই তহবিল। এগুলোর অভাবে এখনও রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় শাখা কার্যালয় স্থাপন করা যায়নি। এদিকে ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আনোয়ার উল হকের মেয়াদ গত ৬ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আর মন্ত্রণালয় গঠন করা হলেও কাজের বণ্টন বা সংশোধন না হওয়ার কারণে মন্ত্রণালয়টি কার্যকর হয়ে উঠতে পারেনি। সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত জমি প্রকৃত মালিকের কাছে হ্স্তান্তর করার জন্য চুক্তি করা হলেও বাস্তবে কোনও জমি হস্তান্তর হয়নি। সেনাক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে ৭০টি ক্যাম্পের মধ্যে ৩৫টি প্রত্যাহারের কথা বলা হলেও নতুন করে আরও কিছু ক্যাম্প স্থাপনের অভিযোগ করেছে পাহাড়িরা।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়
প্রতিবেদনটির বিষয়ে জনসংহতি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ১৯টি ধারাকে আমরা মৌলিক হিসেবে বিবেচনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে শান্তিচুক্তির যেসব ধারা বাস্তবায়ন জরুরি এবং যেসব ধারা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি তা নিয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, চুক্তির ধারাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই পাহাড়ে শান্তি আসছে না। পাহাড়িদের জমি বেহাত হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে পার্বত্য এলাকার মানুষ। তিনি বলেন, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আর অধিকার আদায়ের জন্যই এই চুক্তি করা হয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এই চুক্তি হয়। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে শান্তি ফিরবে। আমাদের অধিকার আদায় হবে। তিনি বলেন, চুক্তিতে সেনা ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা নেওয়া হয়নি। এ কারণে সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে সেই পরিস্থিতি নেই। গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হলে অবশ্য সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। সেই সঙ্গে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন জরুরি।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, এটি কোনও সাধারণ চুক্তি নয়। এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্যোগ জরুরি। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, পাবর্ত্য এলাকার মূল সমস্যা ভূমি বিরোধ। এই বিষয়টি নিষ্পত্তি হলেই অন্য বিষয়গুলো সমাধান করা সহজ হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খোলামেলা আলোচনাও জরুরি বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) রমা রানী রায় বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোনও সমস্যা তৈরি হলে তা দ্রুত সমাধানও করা হচ্ছে। পার্বত্য এলাকার শান্তি প্রতিষ্ঠাই এই মন্ত্রণালয়ের কাজ।
তিনি জানান, মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি ধারাগুলোর মধ্যে ১৫টি আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ৯টি ধারা বাস্তবায়নাধীন বলে তিনি জানান।

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রদল নেতা জনি হত্যা: সাবের হোসেনসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
ছাত্রদল নেতা জনি হত্যা: সাবের হোসেনসহ ৬২ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
চট্টগ্রামে করোনায় আরও ৫ জন আক্রান্ত
চট্টগ্রামে করোনায় আরও ৫ জন আক্রান্ত
বিকালে এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন অর্থ উপদেষ্টা
বিকালে এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন অর্থ উপদেষ্টা
নিউইয়র্কে ‘গোধুলিবেলায়’ নাটকের মঞ্চায়ন
নিউইয়র্কে ‘গোধুলিবেলায়’ নাটকের মঞ্চায়ন
সর্বাধিক পঠিত
খুলনা প্রেসক্লাবে প্রেস সচিবকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ
খুলনা প্রেসক্লাবে প্রেস সচিবকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ
সরকারি গাড়িতে দাওয়াতে গেলো ইউএনও’র পরিবার
সরকারি গাড়িতে দাওয়াতে গেলো ইউএনও’র পরিবার
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলেন অফিস সহকারী হয়ে, বেরোলেন এমবিএ’র সনদ নিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলেন অফিস সহকারী হয়ে, বেরোলেন এমবিএ’র সনদ নিয়ে
‘সরকার দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ না করলে আন্দোলন ঘোষণা করবো’
‘সরকার দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ না করলে আন্দোলন ঘোষণা করবো’
মুরাদনগরে গলায় ছুরি ধরে নারীকে ধর্ষণ, থানায় মামলা
মুরাদনগরে গলায় ছুরি ধরে নারীকে ধর্ষণ, থানায় মামলা