সংসদীয় কার্যক্রমে তারা সক্রিয়। সংসদে উপস্থিতিও সরব। তাদের ছাড়া প্রায় সময়েই অধিবেশনের কোরাম পূর্ণ হয় না। আইনগতভাবেও সমান। আইনি সুযোগ-সুবিধাও সমানভাবে পেয়ে থাকেন। কিন্তু সংসদের বাইরে গেলেই যত বাধা। নানা ধরনের অসহযোগিতা। হয়রানি-লাঞ্ছনার শিকার। নেই কোনও সংসদীয় এলাকা। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সংরক্ষিত আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের চিত্র।
সাড়ে তিনশ’ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা ৫০ জন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৪২ জন, জাতীয় পার্টির ৬ জন এবং জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির একজন করে সংরক্ষিত আসনের মহিলা এমপি রয়েছেন। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোটায় ৩ জন নির্বাচিত হলেও পরে তারা দলে যোগ দেন।
সংবিধান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংরক্ষিত আসনের এমপিরা নিজ-নিজ দলের সংসদ সদস্যের আনুপাতিক কোটায় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার কারণে তাদের কোনও নির্বাচনি এলাকা নেই। ফলে তাদের দায়-দায়িত্বও নেই। তবে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিত্বের সমতার জন্য আঞ্চলিকভাবে নারী এমপিদের নির্বাচন করেছে। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব এমপিকে এক বা একাধিক জেলার দায়িত্বও দিয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর তারা নির্ধারিত এলাকা না পাওয়ায় নানা দাবি-দাওয়া করায় সরকারি দলের চিফ হুইপ এসব এমপির কার্যক্ষেত্র নির্ধারণ করে তাদের সহযোগিতার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়। তবে এর কোনও আইনি ভিত্তি নেই।
বর্তমান সংসদের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যদের বাস্তবতা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে-প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় দলের সাধারণ আসনের এমপি ও একই দলের সংরক্ষিত আসনের নারী এমপিদের মধ্যে ঘোরতর বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এলাকায় নির্বাচিত এমপিদের প্রভাব বেশি থাকায় সংরক্ষিত আসনের এমপিরা কোণঠাসা হয়ে থাকেন।
দু’পক্ষের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে মামলা হামলার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী সংসদ সদস্য এলাকার কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে গিয়ে সরাসরি নির্বাচিত এমপিদের অসহযোগিতার মুখোমুখি হন। কোথাও কোথাও আক্রমণ প্রতিরোধের মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাদের। এদিকে সরকারের বিভিন্ন খাত থেকে দেওয়া বরাদ্দ ও উন্নয়ন কার্যক্রমের বেশিরভাগ নির্বাচিত এমপির মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ার কারণে জনগণও তার দিকে ভিড়ে থাকেন।
সংরক্ষিত আসনের অভিযোগ করেছেন,এলাকায় কাজ করতে গেলে তারা নানা রকম বাধার মুখে পড়েন। ভবিষ্যতে আসন হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় অনেক নির্বাচিত এমপিই নারী এমপিদের এলাকায় সক্রিয়ভাবে কাজ করতে দেন না। সাধারণ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে থোক বরাদ্দ পেলেও সংরক্ষিত আসনের সদস্যরা তা থেকে বঞ্চিত। এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিতেও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যদের অবদান রাখার সুযোগ নেই বললেই চলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং কমিটির প্রধানের দায়িত্বও তারা পান না। এর বাইরে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নারী এমপিদের স্থানীয় সাবেক এমপি বা পার্শ্ববর্তী নির্বাচনি এলাকার এমপিরা বিভিন্নভাবে অসহিযোগিতামূলক আচরণ করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব অসহযোগিতার বিষয়ে স্পিকারের কাছেও অভিযোগ করেছেন অনেক এমপি। এই প্রতিবেদক নিজেও স্পিকারের কাছে অন্ততঃ দুইজন মহিলা এমপিকে অভিযোগ করতে দেখেছেন।
অবশ্য বেশিরভাগ এমপিই নতুন শঙ্কায় এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলতে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন কেউ কেউ। এদিকে বেশ কয়েকজন এমপি এলাকায় কাজ করার প্রশ্নে সমস্যায় পড়েন না দাবি করলেও সাধারণ নির্বাচনে তারা সরাসরি নির্বাচন করতে তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন।
সংরক্ষিত আসনের এমপিদের ক্ষমতার চিত্র ফুটে উঠেছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় সিনিয়র নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বক্তব্যে। চলতি দশম জাতীয় সংসদের ২০১৫-১৬ অর্থ বছরের বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে এরশাদ বলেছিলেন, ‘আমরা কথায় কথায় বলি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, সংসদ উপনেতা নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। কিন্তু এরা তো শোপিস। বাইরে কিন্তু এই অবস্থা নেই। বাইরে নারীরা অসহায়।’ পরে অবশ্য সংরক্ষিত আসনের এমপিরা এরশাদের ‘শোপিস’ শব্দটি নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংরক্ষিত আসনের এমপি অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম বলেন, নির্বাচিত ও সংরক্ষিত আসনের এমপি হিসেবে মর্যাদার দিক থেকে সমান হলেও দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এলাকায় কাজ করতে গিয়েও আমরা সেটা বুঝতে পারি। নির্বাচিত এমপি হিসেবে আমি যেভাবে জনগণের থেকে সাড়া পেয়েছি এখন সংরক্ষিত আসনের এমপি হিসেবে তা পাই না।
অবশ্য তার এলাকায় জাতীয় পার্টির এমপি থাকায় তিনি অন্যদের মত সমস্যায় পড়েন না বলে জানান। তিনি বলেন, জনগণ আমাদের নৌকার এমপি মনে করেন। আর আমি তো নেত্রীর নির্দেশে আসনটি ছেড়ে দিয়েছি। এবারও মনোনয়ন পেতে কাজ চালাচ্ছি।
প্রসঙ্গত: এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির আবু হোসেন বাবলার সঙ্গে সানজিদা খানমের একাধিকভারে বিরোধ হয়ছে।
সংরক্ষিত আসনের বেশ কয়েকজন এমপি স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুললেও তারা প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে রাজি হননি। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের ওপর নতুন নতুন চাপ সৃষ্টি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সংসদ সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করাটা কতটা কঠিন তা আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি।
সংরক্ষিত আসনের এমপিরা নির্বাচিতদের গলার কাঁটা মন্তব্য করে তিনি জানান, সরাসরি নির্বাচন করতে চাইলে স্থানীয় এমপি ও তার কর্মী বাহিনীর নানা চাপের মুখে পড়ি। মুখ খুলে বলি না। কারণ, বলতে গেলে আরও সমস্যা হবে।
অপর এক সদস্য বলেন, তিনি অনেক প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করেন। তিনি ছাড়া অন্য কোনও নারী তার আসনে হলে এলাকায় ঢুকতে পারতেন বলে মনে হয় না।
অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা বাপ্পী বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা তার নির্বাচনি এলাকা। এলাকায় কাজ করতে গিয়ে কোনও সমস্যায় পড়েন না। স্থানীয় এমপিরা তাকে আদর করেন। সহযোগিতা করেন। আগামী নির্বাচনে বাপ্পী নড়াইল বা ব্রহ্মণবাড়িয়া মনোনয়ন চাইবেন বলেও জানান।
নিজের মরহুম বাবা ও চাচার প্রভাব-প্রতিপত্তির ধারাবাহিকতায় এলাকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সুন্দর সাড়া পান সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য মাহজাবিন খালেদ। সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার (অব.) খালেদ মোশাররফের কন্যা ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মোশাররফের ভাতিজি মাহজাবিন বাংলা ট্রিবিউন বলেন, অন্যদের বিষয় জানি না। তবে, আমার ব্যাপারটি ভিন্ন। আমার পরিবার আওয়ামী লীগ করে আসছে। আমার বাবার পরিচায়, চাচার পরিচয়ের জন্য কাজ করাটা অন্যরকম। আওয়ামী লীগের নেতাদের কথা বলতে পারবো না। তারা অনেক সমস্যা করেন। কিন্তু আমার বাবা ও চাচার কথা চিন্তা করে সাধারণ মানুষ আমার কাছে দৌড়ে আসেন। তাদের থেকে খুবই উৎসাহ পাই। এই কারণে মনে হয় অন্যান্য সংরক্ষিত আসনের এমপিদের তুলনায় আমার জন্য কাজ করা সহজ হচ্ছে।
স্থানীয় নির্বাচিত এমপি ও তিনি সংরক্ষিত আসনের এমপি হওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কোন পক্ষে যাবেন তা নিয়ে দ্বিধায় থাকেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য তাকে কীভাবে গ্রহণ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে। ওই নির্বাচনে আমি মনোয়ন চাইবো। সেই বেলায় এই বিষয়ে কথা না বলাই ভালো।
তিনি জানান, তাদের হাতে উন্নয়নের কোনও কাজ থাকে না। বরাদ্দ পান সাধারণ এমপির তিনভাগের একভাগ। সেটাও ব্যয় করতে হয় পুরো জেলাতে।
নারী সংসদ সদস্যদের বিষয়ে কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সরাসরি ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আর কোটার সংসদ সদস্য জনগণ একই চোখে দেখে না। সরাসরি ভোটে যিনি নির্বাচিত, তাকে মানুষ জানে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে। জনগণের কাছেও তাদের জবাবদিহি থাকে, তা যত অল্পই হোক। কোটায় যিনি সংসদ সদস্য তার জবাবদিহি শুধু তার কাছে, যিনি তাকে অনুগ্রহবশত সাংসদ বানিয়েছেন।
যা বললেন স্পিকার:
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারী সংসদ সদস্যের নির্ধারিত এলাকা নেই। নির্বাচিত এমপিদেরই নির্ধারিত এলাকা রয়েছে। তবে,তারা চাইলে সারা বাংলাদেশে কাজ করতে পারেন। চিফ হুইপ যে চিঠি দিয়েছেন ওটা দিয়ে তো এলাকা নির্ধারণের সুযোগ নেই। ওই এলাকায় কাজ করবেন সেটা হয়তো জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘সংসদের বাইরেও নারী সংসদ সদস্যের ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। তারা নারীদের ক্ষমতায়ন, বাল্য বিবাহ নিরোধ, নারী নির্যাতন বন্ধ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিষয়ভিত্তিক যে কোনও ইস্যুতে কাজ করতে পারেন।’
কাজ করতে গিয়ে এলাকার এমপিদের অসহযোগিতার বিষয়টি স্পিকারের জানা নেই বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো সংরক্ষিত আসনের এমপি হিসেবে কাজ করছি না। এটা আমার অভিজ্ঞতায়ও নেই। কাজেই তাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে কী না তা আমার জানা নেই। নির্বাচিত এমপির এলাকায় সংরক্ষিত আসনের এমপিদের কাজের পরিবেশ এটা যারা কাজ করেন তারাই বলতে পারবেন।’
তবে, তিনি বলেন, সংরক্ষিত ও সরাসরি নির্বাচিত সব এমপিই আইনগতভাবে সব ক্ষেত্রেই সমান সুযোগের অধিকারী। সংসদে যেমন তারা সব কার্যক্রমে সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। তেমনি বাইরে দেশের যে কোনও জায়গায় যে কোনও বিষয়ভিত্তিক কাজের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন এবং করছেনও। দেশের বাইরেও তারা ভূমিকা রাখছেন। স্পিকার দেশের বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কে সমান সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করেন বলে জানান।
কাজের ক্ষেত্রে বাধার প্রশ্নে স্পিকার বলেন, কেবল নারী এমপি নয়, দেশের প্রেক্ষাপটে সব নারীর ক্ষেত্রে সমান। তারা যে কোনও কাজে গেলেই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ওই চ্যালেঞ্জ সবার জন্য রয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গন বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য বা পেশায় বলেন—আমরা কর্মক্ষেত্রে এখন নারীদের দৃশ্যমান উপস্থিতি দেখছি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এসে তারা যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন তার থেকে উত্তোরণে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। আমরা চাই নারীরা এগিয়ে আসবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। ভূমিকা রাখতে এসে তারা অনুকূল পরিবেশ না পেলে ঝরে যাবে। সেজন্য তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথটিতে আমরা যতটুকুই সহযোগিতা ও অনুকূল করবো ততই তারা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে যেতে পারবেন।’