X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মানসিক চাপে কন্ট্রোলাররা, ৩৭ বছর পর বদলাচ্ছে এটিসি ব্যবস্থাপনা

চৌধুরী আকবর হোসেন
২০ অক্টোবর ২০২০, ১২:০৬আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২০, ১২:৫৫

পুরনো একটি রাডার, ত্রুটিপূর্ণ রেডিও ব্যবস্থা দিয়েই চলছে দেশের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট

৩৭ বছরের পুরনো একটি রাডার, ত্রুটিপূর্ণ রেডিও ব্যবস্থা দিয়েই চলছে দেশের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট। প্রায় সময়ে রাডারে ধরা পড়ে না আকাশ উড়ে যাওয়া বিমান, পুরনো রেডিও ব্যবস্থায় প্রায় সময় পাইলটের সঙ্গে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (এটিসি) যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কখনও কখনও পরিষ্কারভাবে কথোপকথনে শুনতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা। এতে যেকোনও সময় দুর্ঘটনার ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। এমন এয়ার ট্রাফিক সিস্টেম দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন নিরাপদ এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করতে গিয়ে মানসিক চাপে থাকেন কন্ট্রোলাররা। তবে আশার কথা, এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তবে এটি স্থাপন করতেও লেগে যাবে কমপক্ষে চার বছর। ফলে সহসাই চাপমুক্ত হচ্ছেন না এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা।

প্রতিনিয়ত আধুনিক প্রযুক্তির উড়োজাহাজ যুক্ত হচ্ছে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোতে। কিন্তু এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট আধুনিকায়ন হয়নি। নিরাপদ বিমান চলাচলের জন্য প্রয়োজন আধুনিক এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট। আর আধুনিক এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট পরিচালনার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত দক্ষ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। পুরনো এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট দিয়েই নিরাপদ বিমান চলাচলে কাজ করে যাচ্ছেন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে ঘটে না কন্ট্রোলারদের বিচক্ষণতায়। তবে তাদের এই বীরত্বপূর্ণ গল্প অজানাই থেকে যায়। আবার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ভুল করলে পরিণতি কী হতে পারে, তা মনে করিয়ে দেয় নেপালে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান দুর্ঘটনা।

৩৭ বছর পর বদলাচ্ছে এটিসি ব্যবস্থাপনা

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের জন্য উড়োজাহাজ ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলেই শুরু হয় বিপত্তি। লো-হাইটে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি পেতে সমস্যায় পড়তে হতো পাইলটদের। রেডিও এন্টেনার হাইট বৃদ্ধি করে এ সমস্যার সমাধান হলেও পুরনো এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের কারণে পাইলট ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। নিরাপদে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ, ওভার ফ্লাইংয়ে ঝুঁকি রয়ে গেছে।

ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টার্মিনাল ভবনের উত্তর পাশেই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার। তবে এই টাওয়ারটি টার্মিনাল ভবন থেকে বেশি উচ্চতা না থাকায় পুরো বিমানবন্দর নজরদারিতে বিপত্তিতে পড়ছেন কন্ট্রোলাররা। অন্যদিকে টাওয়ারে জায়গা কম হওয়ায় সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই টাওয়ারে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা ২৪ ঘণ্টা উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টারের পাইলটদের চলাচলে নির্দেশনা দেন। বাংলাদেশের  আকাশসীমায় উড়োজাহাজের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ, আবহাওয়ার তথ্য প্রদান, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উড্ডয়ন-অবতরণের অনুমতি, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ডে চলাচল, পার্কিং–এ বিষয়গুলোর ভিত্তিতে পৃথক পৃথক রেডিও চ্যানেলের মাধ্যমে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা পাইলটদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। অন্যদিকে ৩৭ বছরের পুরনো রাডার সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য শনিবার দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বন্ধ রাখার কারণে পুরোপুরি রেডিও ব্যবস্থার ওপর নির্ভর থাকতে হয়। পুরনো রাডার, দুর্বল রেডিও সিস্টেমের কারণে বাড়তি চাপে থাকতে হচ্ছে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের।

 

মানসিক চাপে কন্ট্রোলাররা, ৩৭ বছর পর বদলাচ্ছে এটিসি ব্যবস্থাপনা

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানালেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের কন্ট্রোলাররা সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের টাওয়ারের যে স্পেস ম্যানেজমেন্ট, যন্ত্রপাতি–এসবের ঘাটতি রয়েছে। আমাদের নতুন টাওয়ার স্থাপনের টেন্ডার হয়েছে, কিছুদিনের মধ্যে কাজ শুরু হবে। সেটা হয়ে গেলে আমরা একটি আধুনিক মানের টাওয়ার পাবো। প্রয়োজনের তুলনায় কন্ট্রোলারের সংখ্যাও কম। জনবল নিয়োগের কার্যক্রম শুরু হলে এ সংকট কাটবে।’

তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও ফাইটার পাইলট। ২০০০ সাল থেকে এ বিমানবন্দরে ফ্লাই করে আসছি। রেডিও ট্রান্সমিশনের সমস্যা হয়, মাঝে মাঝে জ্যামিং হয়ে যায়। টাওয়ার ফ্রিকোয়েন্সিতে কল দিলে দেখা যাচ্ছে শব্দ হচ্ছে, কিন্তু কেউ কারও (পাইলট ও কন্ট্রোলার) কথা শুনতে পারছেন না। আমাদের নিজস্ব প্রকৌশলীরা এ সমস্যা খোঁজার চেষ্টা করছেন কিন্তু কেন এমন হচ্ছে তা তারা ধরতে পারেননি। বিটিআরসি’কে জানানো হলে তারাও তিন-চার দিন এখানে সার্ভে করে কোনও সমস্যা পায়নি।’ 

তবে আশার কথা হচ্ছে ৩৭ বছরের রাডার বদলে আধুনিক ডিজিটাল রাডারসহ এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফ্রান্স থেকে অত্যাধুনিক রাডার জিটুজি পদ্ধতিতে কিনতে সমঝোতা স্মারক হবে নভেম্বরে। এ সংক্রান্ত চুক্তি বেবিচকের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ফ্রান্সের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব সিভিল অ্যাভিয়েশন এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মধ্যে চুক্তির খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।  তবে নতুন রাডার স্থাপন, টেস্ট রান করে আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশনসহ অন্যান্য সংস্থার অডিট শেষে ব্যবহার উপযোগী করতে লাগবে চার বছর।

এ বিষয়ে বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আধুনিক নেভিগেশন ও কমিউনিকেশন চালু করতে আমরা কাজ করছি। ফ্রান্স থেকে অত্যাধুনিক রাডার কেনা হবে। শিগগির একটি চুক্তি হবে ফ্রান্সের সঙ্গে। এর ফলে এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আধুনিক হবে।’

মানসিক চাপে কন্ট্রোলাররা

বাংলাদেশে এয়ার ট্রাফ্রিক কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্টের মতো কন্ট্রোলাররাও অবহেলিত। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি কন্ট্রোলারের সংখ্যা। প্রায় ৩০ জন কন্ট্রোলার ২৪ ঘণ্টা পালাক্রমে কাজ করেন। তবে কর্মপরিবেশ, জনবল সংকট, বেতন কাঠামো, রিস্ক অ্যালাউন্স, নিয়োগ পদ্ধতি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ রয়েছে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলাররা জানিয়েছেন, বেবিচকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের শিফট ম্যানেজমেন্ট, বদলি, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ এসব বিষয়ে সুষ্ঠু কোনও ব্যবস্থাপনা নেই। মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করলেও নেই কোনও পুরস্কার, ঝুঁকি ভাতা। দিনে ৬ ঘণ্টার শিফটে কাজ করলেও রাতে করতে হয় একটানা ১২ ঘণ্টা, তবে তার জন্য নেই আলাদা অ্যালাউন্স। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাইলটদের মতো এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের বেতন বেশি হলেও বাংলাদেশে তা নেই। পদের সংখ্যা কম হওয়ায় ধীরগতিতে হয় পদোন্নতি।

বেবিচকে পরিকল্পনা ও পরিচালনা বিভাগের অধীনে পরিচালিত হতো এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজেমেন্ট। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে পৃথক এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) বিভাগ চালু করে বেবিচক। নতুন চালু হওয়া এ বিভাগের প্রথম সদস্য হিসেবে ৫ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ মেহবুব খানকে নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র সাত মাসের মাথায় এ বিভাগ থেকে তাকে বিমান বাহিনীতে প্রত্যাবর্তন করা হয়। আর নতুন করে নিয়োগ পান এয়ার কমোডর মো. আমিনুল ইসলাম।

২০১৭ সালের একটি ঘটনার কথা বললেন একজন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কন্ট্রোলার বলেন, ‘সেদিন ভিভিআইপি মুভমেন্ট ছিল। এয়ার অ্যারাবিয়ার একটি ফ্লাইটকে ল্যান্ডিং ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হলো। কিন্তু সেই সময়ে একটি হেলিকপ্টার ভুল করে রানওয়েতে ঢুকে পড়ে, নিশ্চিতভাবে একটি ‍দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে আমরা আঁতকে উঠি। তবে দুর্ঘটনা ঘটার আগেই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিই, হেলিকপ্টারটিকে সরিয়ে এয়ার অ্যারাবিয়ার ফ্লাইটটি নিরাপদে অবতরণ করার ব্যবস্থা করা হয়। এমন অনেক ছোট-বড় ঘটনাই ঘটে, কিন্তু এসব সবার অজানা থেকে যায়।’

প্রায় সময়ে পাইলটদের ভূমিকার জন্য স্বীকৃতি, পুরস্কার দেওয়া হলেও দেশে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের পুরস্কৃত করার নজির নেই। সারা বিশ্বে ২০ অক্টোবর পালন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলারস’ দিবস। বাংলাদেশে কখনোই এ দিবসটি পালন করা হয়নি।

 

 

/এমএএ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নিলামে উঠছে ম্যারাডোনার গোল্ডেন বল
নিলামে উঠছে ম্যারাডোনার গোল্ডেন বল
ভরিতে সোনার দাম বাড়লো ৪৫০০ টাকা
ভরিতে সোনার দাম বাড়লো ৪৫০০ টাকা
চট্টগ্রাম কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির মৃত্যু
চট্টগ্রাম কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির মৃত্যু
মতিঝিলে ২০০ মিটার রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত
মতিঝিলে ২০০ মিটার রাস্তা অবৈধ দখলমুক্ত
সর্বাধিক পঠিত
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
বৃষ্টি ও বন্যার কী পূর্বাভাস পাওয়া গেলো?
বৃষ্টি ও বন্যার কী পূর্বাভাস পাওয়া গেলো?
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হামাস, অগ্রহণযোগ্য বলছে ইসরায়েল
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট