(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ৬ জানুয়ারির ঘটনা।)
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের এই দিনে গোপালগঞ্জে ঘোষণা করেন, নতুন দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী কায়েমী স্বার্থবাদীদের জঘন্য ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সমগ্র দেশবাসী বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধু কলেজ ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণকে ও দেশকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নির্বাচনের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্রে মেতেছে তারা।’ তিনি বলেন, ‘এসব লোককে জনগণের নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের দিনে কখনও দেখা যায়নি। এখন তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য গোলমাল বাঁধাতে চাইছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো—যাতে আমাদের উন্নয়নের জন্য বিদেশি সাহায্য না আসে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তারা আবোল-তাবোল বকছে।’ বিশাল জনতাকে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, তিনি কখনও আইয়ুব খান এবং ইয়াহিয়া খানের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি বলেন, ‘আমি কারও কাছে মাথা নত করবো না।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণ তাকে পাঁচ বছরের জন্য ভোট দিয়েছিল। কিন্তু তিনি অনেক তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের কাছে ভোটের জন্য আসিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনারা আমাকে ভোট দেবেন। কারণ, আপনারা আমাকে ভালোবাসেন এবং আমি আপনাদের ভালোবাসি।’
১০ মিনিট বেশি কথা বললেন
প্রধানমন্ত্রী ২০ মিনিটে ভাষণ শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জনগণের দাবির কারণে তাকে আরেও ১০ মিনিট কথা বলতে হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ভারতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ভারত এখনও আমাদের জনগণের জন্য খাদ্যশস্য দিয়ে সাহায্য করছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশবাসীকে তিনি বলেছিলেন যে তিন বছর কিছু দিতে পারবেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গকে পাঁচ কোটি টাকা দিয়েছি। এছাড়া একশ’ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। চার কোটি টাকা নিয়ে পঙ্গু ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনে সহায়তা করার জন্য বিদেশ থেকে আসা সাহায্যের সুষ্ঠু সরবরাহ রোধ করে, দেশের অগ্রগতি ব্যাহত করতে, দেশের মর্যাদাকে বিদেশে হেয় করার জন্য, যারা এখনও চক্রান্ত করছে, জনগণের অপরিসীম ভালোবাসা, আশীর্বাদ ও সহযোগিতা নিয়ে তার দল ও সরকার তাদের নির্মূল করবে। বিদেশি স্বার্থ এসব ক্ষতিকর লোককে সাহায্য ও মদত জোগাচ্ছে।’
জনগণ এদের নির্মূলে সায় দিলো
প্রধানমন্ত্রী গোপালগঞ্জের জনসাধারণের কাছে গণবিরোধী শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করতে এবং যেভাবে লড়াই করে তারা স্বাধীনতা এনেছিলেন, সেই একইভাবে দেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে ইচ্ছুক কিনা, তা জানতে চান। গোপালগঞ্জের মহান সন্তানেরা তার কথায় সায় দিয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান তুলে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদায়ক নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থা জ্ঞাপন করে দুই হাত তুলে ধরেন।
শৈশবে ফিরে যান তিনি
আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাঁর জন্মস্থান সেখানে। তিনি তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন এখানে। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই তার ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের সূচনা। সেই গোপালগঞ্জের সঙ্গে তাঁর গভীর স্মৃতি স্মরণ করেন। তিনি তাঁর সম্মুখে দেখিয়ে বলেন, ‘এই হচ্ছে সেই মাঠ, যেখানে তিনি ফুটবল খেলতেন। ওখানে আগেও তিনি সভায় বক্তৃতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে খুব কমই গ্রাম আছে, যেখানে তিনি যাননি। এমন ঘর কমই আছে যেখানে তিনি খাননি।’ অশ্রুসজল চোখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও মর্যাদার জন্য তিনি রাজনীতি করছেন না। করছেন বাংলাদেশের অগণিত মানুষকে সুখী, সন্তুষ্ট ও সমৃদ্ধশালী করার জন্য।’ তিনি বলেন, ‘তার জীবনের একমাত্র উচ্চাভিলাষ হলো— এই শোষিত ভাগ্যাহত দেশকে সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত করা।’
দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ইয়াহিয়া সাহেব, যিনি কিনা তাঁকে কারারুদ্ধ করেছিলেন, আজ নিজেই কারাগারে পচছেন।’ দেশের খাদ্য সমস্যা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাঁর সরকার দেশের খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করেছে। আগামী দিনে যাতে কোনও ঘাটতি না থাকে, তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সরকার আরও খাদ্যশস্য সংগ্রহ করছে। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য দেশ অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারে না। আমাদের অবশ্যই খাদ্য উৎপাদন করে যত শিগগির সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে।’
সেদিন বঙ্গবন্ধুকে শুধু একনজর দেখার জন্য নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে হাজার হাজার লোক এই ছোট শহরে ভেঙে পড়েছিল। সেদিন শেখ কামাল ও শিশু রাসেলসহ তিনি হেলিকপ্টারযোগে অবতরণ করলে জনতা মুহুর্মুহু জয়ধ্বনিতে তাঁকে স্বাগত জানান। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা তাঁকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করেন।