১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি। এক বছর আগে এই দিনে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ঠিক এক বছর পর স্বাধীন দেশে তিনি সেদিন ছিলেন পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনীর প্রথম ব্যাচের সত্যায়নের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে। সেখানে তিনি অভিবাদন গ্রহণ করার পাশাপাশি বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে অবহিত করেন। সেদিন সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান চিরতরে বন্ধ করার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশ রাইফেলস বাহিনীকে সীমান্তে পাঠানো হবে উল্লেখ করে জাতির পিতা বলেন, শহীদের রক্তের কথা মনে রেখে জনসাধারণের সহযোগিতায় চোরাচালান স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। কাজের জন্য সেনাবাহিনী সীমান্তে ছিল। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিন সীমান্তে রাখা যাবে না। ওই দিন প্রায় তিন হাজার রংরুট আকর্ষণীয় কুচকাওয়াজে অংশ নেন ও শপথ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে তারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত থাকার অঙ্গীকার করেন। মাতৃভূমির স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং সীমান্ত রক্ষা করবেন এবং প্রাণ দিয়ে হলেও চোরাচালান বন্ধ করবেন। আদর্শ ও সুশৃংখল থাকা এবং জনসাধারণকে ভালোবাসার আহ্বান জানিয়ে জাতির পিতা বলেন, তাদের অবশ্যই ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশ পালন করতে হবে। কেননা শৃঙ্খলা ছাড়া কোনও বাহিনী এগিয়ে যেতে পারে না।
বঙ্গবন্ধু বলেন সশস্ত্র বাহিনী, রক্ষীবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস এবং পুলিশ বাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের সন্তান। মাতৃভূমির সেবা ও তাকে রক্ষা করা তাদের কর্তব্য। স্বাধীনতা রক্তের বিনিময়ে এসেছে তাই জনগণের সহযোগিতা ও প্রয়োজনবোধে রক্ত দিয়েই সেই স্বাধীনতা রক্ষায় তাদের সদা প্রস্তুত থাকতে হবে। জাতির পিতা বলেন, ‘আমি জানি আপনারা মাতৃভূমিকে ভালোবাসেন, আমাকে ভালোবাসেন। জনসাধারণকেও আপনাদের ভালবাসতে হবে। কেননা জনসাধারণই আপনাদের বাবা-মা ভাই।’
সবাইকে সৎ পথে থাকার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সৎ পথে থাকুন, আল্লাহ আপনাদের সহায় হবেন। চরিত্র গঠন করুন। কারণ সোনার বাংলা গড়তে সোনার মন লাগবে। এটা দেখিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশের জনগণ শুধু স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম তা নয়, দেশকে রক্ষার দায়িত্ব পালনের যোগ্যতাসম্পন্নও।’
জাতির পিতা বলেন, ১০ বছর ধরে বাঙালিকে ভীরু অপবাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়নি। কিন্তু আজ বাঙালি প্রমাণ করেছে তারা সামরিক জাতি। কারোর চেয়ে কম নয়।
প্রধানমন্ত্রী সেইদিন পিলখানা পৌঁছলে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। জিপে চড়ে বঙ্গবন্ধু যখন কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান এবং বিডিআর-এর পরিচালক তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর (তৎকালীন ইপিআর) ভূমিকা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনাদের মাঝে আসতে পেরে আমি আনন্দিত।' ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাধারে বিডিআর, পিলখানা সদর দফতর, রাজারবাগ, পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তার বাসভবনে আক্রমণ চালায়। তার ডাকে রাইফেলসের জওয়ানরা খালি হাতে বীরত্বের সঙ্গে পাকসেনাদের মোকাবিলা করেছে। শত শত জওয়ান প্রাণ দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, 'আপনাদের অসুবিধাগুলো আমার জানা আছে। শত্রু আপনাদের আবাস ধ্বংস করেছে। আপনাদের কাপড় ও বাসস্থানের সমস্যা আছে। তবুও আপনাদের কর্তব্য করে যেতে হবে। জনগণকে ভালবাসতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করতে হবে। চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। আপনাদের যাতে দুর্নাম না হয় সেদিকে সজাগ থাকবেন।'