(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ৯ জানুয়ারির ঘটনা।)
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, আগামী ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে কোনও মহলের কোনো রকম হস্তক্ষেপ থাকবে না। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ এবং এখানে নির্বাচনে কারও কোনও রকম হস্তক্ষেপ চলবে না।’ ১৯৭৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বিকালে নাটোরে এক জনসভায় ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু একথা ঘোষণা করেন। তিনি জানান, সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জাতির কাছে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন এবং তার অঙ্গীকার পূর্ণ হবে ৭ মার্চের অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমেই। দৈনিক বাংলার নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আমি জানি, কিছু লোক বিদেশি শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে দেশের আসন্ন নির্বাচনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু আমি তাদের হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি। ষড়যন্ত্র করবেন না, ষড়যন্ত্রের ফল ভালো হবে না। মানুষ ষড়যন্ত্র বরদাশত করবে না। বাংলার মানুষ ২৫ বছর ধরে পাকিস্তানের হাতে নিষ্পেষিত হওয়ার পর দেশ থেকে তাদের নির্মূল করে স্বাধীনতা এনেছি। প্রয়োজন হলে বাংলার মানুষ ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে আবারও সংগ্রাম করবে।’ দেশের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে, দেশের অভ্যন্তরে অনেকে রয়েছে, যারা পাকিস্তানের দালালি করেছে। বর্বর হানাদার বাহিনীকে মদদ দিয়েছে। তারাই আজ বড় বড় কথা বলছে। তাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সামনে নির্বাচন আসছে। সত্যি সত্যিই তোমরা যদি দেশ দরদী হয়ে থাকো, তবে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চেষ্টা করো। হিংসা গোলমাল সৃষ্টির ষড়যন্ত্র সফল হবে না।’ যারা বর্তমানে দেশে গোলযোগ ও অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টায় লিপ্ত, তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেন, ‘এসব অপচেষ্টায় কোনও লাভ হবে না।’ যারা অস্ত্রের হুমকি দিতে চেষ্টা করছে বঙ্গবন্ধু তাদের সতর্ক করে বলেন, ‘অস্ত্র দেখিয়ে লাভ হবে না। বাংলাদেশের জনগণ এসব অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে জানে। স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশে যারা অস্ত্রের হুমকি দেয়, বাংলাদেশের মানুষ তাদের সহ্য করবে না ‘
চারটি রাষ্ট্রনীতি সমর্থন করতে হবে
বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশে বাস করতে হলে চারটি মৌল রাষ্ট্রনীতি করে নিতে হবে। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সকলকেই চার নীতি মেনে নিতে হবে’ যারা আঞ্চলিকতা ও সংকীর্ণ মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। বাংলাদেশে কেউ কারও ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। বাংলাদেশের মাটিতে সাম্প্রদায়িকতাকে আর কোনো দিনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া হবে না।’
রাজনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি
যারা রাজনৈতিক হত্যার আশ্রয় নিয়েছে, গোপনে আওয়ামী লীগ নেতাদের খুন করছে, তাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ‘যারা এই গোপন হত্যার আশ্রয় নিয়েছে, তাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবেই।’ তিনি বলেন, ‘এইসব খুন ও হত্যার মাধ্যমে তারা দেশের কোনও কল্যাণ করছে না। এটা রাজনীতি নয়।’ তিনি বলেন, ‘হত্যাকারীরা এই হুঁশিয়ারিতে সতর্ক হয়ে যাবে এবং খুন ও হত্যার অপরাধে লিপ্ত হওয়া বন্ধ করবে। না হলে জনগণের হাতে তাদের চরম সাজা পেতে হবে। জনগণ তাদের ক্ষমা করবে না।’
দুর্নীতি প্রতিরোধের আহ্বান
দুর্নীতি ও অপরাধের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। দেশ থেকে ও সমাজ থেকে দুর্নীতি চিরতরে নির্মূল করার বলিষ্ঠ সংকল্প ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে অগ্রসর না হলে, পুলিশ বাহিনীর পক্ষে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব হবে না।’ দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতি তিনি দুর্নীতি পরিহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য দেশে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি দেশ প্রেমিককে সক্রিয় ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ থেকে দুর্নীতি ও অপরাধকে নির্মূল না করতে পারলে কোনও জাতি মহত্ব লাভ করতে পারে না। চোরাচালান বন্ধের জন্য সীমান্তে বাংলাদেশ রাইফেলসের সাহায্যে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। তাতে চোরাচালান বন্ধ হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণার সাপেক্ষে জনতা বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তোলে এবং করতালি দেয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি আশা করি, এরপর ভবিষ্যতে আর কোনও চোরাচালান হবে না।’
এমন অবাধ গণতন্ত্র দেওয়া হয়নি
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যারা দেশের জন্য জনগণের জন্য কিছুই করেনি, দেশ ও জাতির প্রতি যাদের কোনও অবদান নেই, তারাই আজ বড়বড় কথা বলছেন।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে বলেই তাদের আজ এত বড় গলা। কিন্তু বিপ্লবের পর এমন অবাধ গণতন্ত্র পৃথিবীর কোথাও দেওয়া হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণ তাকে ভোট দিয়েছিল। বিনা দ্বিধায় তিনি পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি। জনগণকে সংবিধান দিয়েছেন এবং দেশে নির্বাচন দিচ্ছেন। দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যে জনগণ, তা প্রমাণের জন্য তিনি সংবিধান দিয়েছেন।’
জনগণের ভাত-কাপড় আর কর্মসংস্থানই আমার লক্ষ্য
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দেশের আপামর জনগণের ভাত-কাপড় ও কর্মসংস্থানই আমার লক্ষ্য। আমি চাই, আমার দেশের জনগণ খেয়ে পড়ে সুখে-শান্তিতে মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বাঁচবে। আমার স্বপ্ন, সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। সোনার বাংলা গড়ার জন্য সোনার মানুষ গড়তে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে হৃদয় দিয়ে গড়ে উঠতে হবে। তবেই সম্ভব হবে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠাকরা।’