(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১২ জানুয়ারির ঘটনা।)
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামকালে পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার নারীরা যাতে স্বাধীনভাবে প্রকৃত নাগরিক হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, তার জন্য সরকার সম্ভাব্য সবকিছু করবে। ১৯৭৩ সালের ১২ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আয়োজিত নির্যাতনের শিকার নারীদের হস্তশিল্পের প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই মহিলাদের পুনর্বাসন করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। আমরা দেখতে চাই, ওরা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে সুখী পরিবারের মতো বসবাস করছে।’ বিভিন্ন সংস্থাকে এই মহান দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সবাই মিলে এভাবে এগিয়ে এলে দেশের বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’
প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসুক
সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এরা নির্যাতিত হয়েছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। ওদের কথা আমরা ভুলে গেলে কেউ আমাদের ক্ষমা করবে না।’ এই ধরনের সমাজকল্যাণমূলক কাজে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। যেসব প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে, তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সেবার মহান ব্রত নিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে তিনি যেসব বিদেশি সংস্থা এ কাজে সহায়তা করছে তাদের ধন্যবাদ জানান।
সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই হস্তশিল্প প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী কামরুজ্জামান তাঁর বক্তৃতায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের জাতীয় চরিত্র পরিবর্তনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এ দেশের প্রত্যেকটি মানুষের স্বাধীনতার ফল ভোগের সমান অধিকার আছে।’
কামরুজ্জামান বলেন, ‘সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখছেন আমাদের জাতির পিতা। তাঁর চোখে এ দেশের সবাই সমান। দেশকে গড়ে তোলার ও একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব এ দেশের সকল মানুষের।’
কাঁদিস না আমি তো আছি
অনুষ্ঠানে নির্যাতনের শিকার নারীরা যখন ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন, তখন বঙ্গবন্ধু কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলেন না। ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কোনোমতে বললেন, ‘কাঁদিস না। কোনও চিন্তা নেই, আমি তো আছি। তোদের কোনও দুঃখ আমি রাখবো না।’ কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্রে নির্যাতনের শিকার নারীদের হস্তশিল্পের প্রদর্শনী উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠান শেষ করে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ দেখলেন, গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছে এই কেন্দ্রের মেয়েরা। বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গিয়ে তাদের কুশল জিজ্ঞেস করেন। একটি মেয়ে কোনও কথা বলতে পারছিল না, সে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। পাশের জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন জাতির পিতা। জানতে চাইলেন, তার কুশল। কিন্তু জবাবে মেয়েটির দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা ঝরে, সে কেঁদে ফেললো।
বেলবটম প্যান্ট পছন্দ না বঙ্গবন্ধুর
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেলবটম প্যান্ট পছন্দ করতেন না। শুধু অপছন্দই না, তিনি বিরক্তবোধ করতেন। বাংলাদেশ মহিলা উন্নয়ন সংস্থা আয়োজিত শিল্প প্রদর্শনী পরিদর্শনকালে তিনি তাঁর এই মনোভাব প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। এক জায়গায় তিনি বাচ্চাদের বেলবটম প্যান্ট দেখতে পেয়ে গম্ভীর হয়ে যান এবং প্যান্ট দেখিয়ে বলেন, ‘বেলবটম করেছেন কেন, করবেন না।’
এই দিনে শপথ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। শপথগ্রহণের কিছুক্ষণ আগে তিনি বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন। ইস্তফা ঘোষণার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। নতুন রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের অস্থায়ী শাসনতন্ত্রের আদেশ অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এরপর একে একে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য শপথ নেন। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ১২ জানুয়ারি বহু কাঙ্ক্ষিত সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রচলন ঘটেছিল।