X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

তফসিল বানান নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে বিতর্ক, দ্বৈত বানান পরিহারে আসছে সুপারিশ

এমরান হোসাইন শেখ
০২ মে ২০২৩, ২২:৩০আপডেট : ০২ মে ২০২৩, ২২:৩০

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ‘তফসিল’ বানান নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। সঠিক বানান ‘তফসিল’ নাকি ‘তপশিল’ হবে— তা নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও সংসদ সচিবালয় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিয়ে কমিটির সদস্যরাও জড়িয়ে পড়েন। পরে এই বানানটি সংবিধান ও বাংলা একাডেমির বানান রীতির দ্বৈধতা পরিহারে আইনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়কে একটি প্রতিবেদন চেয়ে অনুশাসন দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার (২ মে) অনুষ্ঠিত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, সংসদীয় কমিটির আগের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। তবে, ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উপস্থিত ছিলেন না। ফলে পরের বৈঠকে তার উপস্থিতিতে আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। বিষয়টি কমিটির বৈঠকে সুপারিশ আকারেও আসে। আগের বৈঠকের সুপারিশে বলা হয়—বানানগত দ্বৈধতা পরিহারের জন্য মন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সংবিধানে বিধৃত বানান ও বর্তমানে বাবাকো (বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ) কর্তৃক প্রমিত বানান দ্বৈধতা পরিহারের ওপর একটি কার্যপত্র কমিটির আগামী বৈঠকে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় উপস্থাপন করবে।

মঙ্গলবারের (২ মে) বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আইন মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হলেও এদিনের বৈঠকেও আইনমন্ত্রী না আসায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। বানানে দ্বৈধতা রয়েছে—এমন কয়েকটি শব্দ নিয়ে আলোচনা হলেও আইনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনার জন্য এজেন্ডাটি পরবর্তী বৈঠকে স্থানান্তর করা হয়েছে।

আগের বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব ‘তফসিল’ বানানের প্রসঙ্গটি তোলেন। পূর্ববর্তী (২৫তম) বৈঠকের কার্যবিবরণীর প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘কার্যবিবরণীর সিদ্ধান্ত/সুপারিশের ২(খ)-এ ‘তফসিলের’ শব্দের পরিবর্তে ‘তপশিলের’ শব্দটি গ্রহণ করা হয়েছে। তফসিল শব্দটি আরবি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় গৃহীত বিধায় ‘তফসিল’-ই হবে।’’ কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, আরবি বর্ণমালায় ‘প’ উচ্চারণের কোনও শব্দ নেই। তাছাড়া, সংবিধানে তফসিল বানানটি ‘ফ’ দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এবং ইন্টারপ্রিটেশনে সংবিধান সবার ওপরে। সেজন্য লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে প্রত্যেকটি বিলে ‘তফসিল’ বানান দিয়েই লিপিবদ্ধ করা হয়। পরে এটাকে সংসদ সচিবালয় থেকে সংশোধন করা হয়। তিনি কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘বিল প্রণয়নের সময় আইনের ভাষাকে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়।’ তিনি বিষয়টি নিয়ে কমিটির সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

সচিবের যুক্তি খণ্ডন করে সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান বলেন, ‘‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো)’ থেকে সরকারি কাজে ব্যবহৃত বাংলা শব্দের একটি নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেখানে ‘তফসিল’-এর পরিবর্তে ‘তপশিল’ শব্দ ব্যবহারের নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী ‘তপশিল’ বানানটি ব্যবহার করা হচ্ছে।’ সুনির্দিষ্ট একটি আইনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘আইনটি সংসদে পাস হওয়ায় এই আইনের ক্ষেত্রে ‘তপসিল’ শব্দটি রাখতে হবে।’’ 

ড্রাফটম্যানের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কমিটির সচিব বলেন, ‘সরকারি অফিসে বাংলা শব্দ ব্যবহারের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাবাকো থেকে নির্দেশনা দিয়েছে। সে অনুযায়ী জাতীয় সংসদ সচিবালয়ও কাজ করে যাচ্ছে।’

বিষয়টি নিয়ে কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সংবিধানে শব্দের বানান একরকম। আবার সরকারি নির্দেশনায় অন্য বানান। সেক্ষেত্রে সংবিধানই সবার ওপরে হবে।’ তারপরেও বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব করেন তিনি।

এ পর্যায়ে সভাপতি বানানের বিষয়টি কমিটির দৃষ্টিতে আনার জন্য সচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এর সঙ্গে একদিকে সংবিধান ও অপরদিকে সরকারের নির্দেশনা থাকায় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বানানটির ‘প’ এবং ‘ফ’ নিয়ে সংসদেও আলোচনা হয়েছে। তাই এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে মন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এছাড়া যদি অন্য কোনও শব্দের বানান নিয়ে কোনও সমস্যা থাকে, তা নিয়েও আলোচনা করা হবে। শব্দ ব্যবহারে বানানের দ্বৈধতা পরিহারের চেষ্টা করা হবে।’ লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করার জন্য বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, বাংলা একাডেমির প্রমিত বানান রীতিকে ভিত্তি ধরে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবকো) প্রকাশিত ‘সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম’ বইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানে বেশ কিছু বানানের দ্বৈধতা রয়েছে। সর্বশেষ মুদ্রিত সংবিধান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে—শহীদ, খ্রীষ্টাব্দ, খ্রীষ্টান, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, সুপ্রীম কোর্ট, নির্বাচনী, সরকারী, বেসরকারী, বিধানাবলী, মেহনতী, মজুরী, শ্রেণী, ফৌজদারী, জারী, মঞ্জরী, দাবী, ইংরেজী, ডিক্রী, রীট, চাকুরী, ঊনআশী, কর্মসূচী, মুলতবী, শর্তাবলী, বাঙালী ইত্যাদি শব্দগুলো ‘দীর্ঘ ঈ-কার’ (ী)-এ লেখা হয়েছে। কিন্তু প্রমিত বাংলা বানানের নিয়মে সবগুলো শব্দেই ‘হ্রস্ব ই-কার’ (ি) হবে। যেমন- স্পীকারের স্থলে স্পিকার, মজুরীর স্থলে মজুরি ইত্যাদি। এছাড়া সংবিধানে ‘অ্যাডভোকেট’ শব্দটি সঠিক হলেও এর স্থলে ‘এ্যাডভোকেট’, ‘দণ্ড’ শব্দটির স্থলে ‘দন্ড’, ‘অসামঞ্জস্য’-এর স্থলে ‘অসামঞ্জস’, ‘খ্রিস্টান’-এর স্থলে ‘খ্রীষ্টান’ লেখা হয়েছে। এছাড়া সংবিধানের মুদ্রণ কপি ছাড়াও আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সংবিধানের যে সফট কপি আপলোড করা হয়েছে, সেখানেও এগুলোর বাইরে বেশ কিছু দ্বৈত বানান রয়েছে।

বানানের দ্বৈধতা নিয়ে নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদন তৈরির সময় প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছিলেন, বাংলা বানানের নিয়ম অনুসারে সংবিধানে যেসব অশুদ্ধ বানান রয়েছে, তা সঠিকভাবে লেখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সংবিধানের সংশোধনীতে যুক্ত করার দরকার হলে, তা বিবেচনা করা হবে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন। তবে ওই প্রতিবেদনের পর ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সংবিধানে একটি সংশোধনী আনা হলেও বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আজকের বৈঠকে আলোচনার কথা থাকলেও আমরা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে আলোচনার জন্য পরবর্তী বৈঠকে স্থানান্তর করেছি। সংবিধানে রয়েছে ‘তফসিল’ আর অন্যান্য আইনে রয়েছে ‘তপশিল’। এই দ্বৈত বানান থাকতে পারে না। কার্যত আমাদের সংবিধানকে প্রাধান্য দিতে হবে।’

তিনি জানান, শুধু এই বানানটি নয়, সংবিধান, দেশের আইন বা বিধি এবং প্রমিত বানান রীতিতে যেসব শব্দের বানানে দ্বৈধতা আছে—আমরা আলোচনার জন্য সবগুলো বিবেচনায় আনবো। এক্ষেত্রে সংবিধান বা আইন সংশোধনের প্রয়োজন পড়লে,  সেই বিষয়ে সুপারিশ করবো। আমরা বিষয়টি ‍খুবই ‍গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি।’

মো. শহীদুজ্জামান সরকারের সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান, আব্দুল মজিদ খান, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, গ্লোরিয়া ঝর্ণা সরকার ও খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন অংশগ্রহণ করেন।

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করতে এমপি-মন্ত্রীদের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
যাদের প্রতি শোক জানালো সংসদ
শিগগিরই শুরু হচ্ছে উন্মুক্ত কারাগার তৈরির কাজ: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
১২ বছর পর মুম্বাইয়ের মাঠে কলকাতার জয়
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা