X
রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
৮ আষাঢ় ১৪৩২

‘শেষ মাইলের’ বাস্তবায়ন চাইলো ইন্দো-বাংলা সংলাপ

রঞ্জন বসু, দিল্লি
২৬ জুন ২০২৩, ০৩:৩৮আপডেট : ২৬ জুন ২০২৩, ০৩:৩৮

ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে হলে দুদেশের মধ্যে চলমান বিভিন্ন প্রকল্পকে যে জরুরি ভিত্তিতে ‘ফিনিশিং টাচ’ দিতে হবে বা শেষ পর্বের কাজটুকু সমাধা করতে হবে, সে ব্যাপারে একমত হলো ইন্দো-বাংলা স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ। ঢাকা ও দিল্লির দুটি প্রথম সারির থিংকট্যাংকের উদ্যোগে গত ২২ ও ২৩ জানুয়ারি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই ‘ট্র্যাক টু’ সংলাপ। তাতেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে খুব খোলামেলা আলোচনা করলেন উভয় দেশের বেসরকারি স্তরের প্রতিনিধিরা।

দিল্লির ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই সংলাপটি যৌথভাবে আয়োজন করেছিল ভারতের অনন্ত অ্যাসপেন সেন্টার ও বাংলাদেশের সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এই দুই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সংলাপটি গত বছরের (২০২২) মে মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে। তবে এ বছর দ্বিতীয় সংলাপটি অবশ্য ‘ইন পার্সন’, অর্থাৎ সশরীরেই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হলো।

ভারত ও বাংলাদেশে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই। সেই পটভূমিতে এই ধরনের ট্র্যাক টু সংলাপের একটা আলাদা গুরুত্ব থাকেই। দুই দেশের সরকারের মধ্যে যে বিষয়গুলো নিয়ে সরাসরি আলাপ-আলোচনা করা অসুবিধাজনক, সেগুলো নিয়ে উভয় দেশের বিশেষজ্ঞ বা নীতিনির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত বিশ্লেষকরা এই ধরনের প্ল্যাটফর্মে খোলাখুলি কথাবার্তা বলতে পারেন এবং আলোচনার নির্যাস নিজ নিজ দেশের সরকারের কাছেও পেশ করতে পারেন।

ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্ট্র্যাটেজিক বিবেচনায় বাংলাদেশের কোনও একটি বিশেষ দিকে ঝোঁকা সম্ভব নয়

যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ঠিক কী ধরনের সম্পর্ক রাখবে, এই ধরনের গভীর স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও দিল্লির এই সংলাপে বিশদ আলোচনা হয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে, ভারতীয় প্রতিনিধিরা আলোচনায় যুক্তি দিয়েছিলেন যে চীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিল, আজ যদি ভারত ও চীনের মধ্যে একটি দেশকে বেছে নেওয়ার প্রশ্ন আসে, তাহলে সেই ইতিহাসকে মাথায় রাখলে বাংলাদেশের জন্য এটি কোনও সমস্যাই হওয়া উচিত নয়। কিন্তু জবাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ব্যাখ্যা করেন, বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্ট্র্যাটেজিক বিবেচনায় বাংলাদেশের কোনও একটি বিশেষ দিকে ঝোঁকা সম্ভব নয় এবং তাদের ইন্দো-প্যাসিফিকে ভারসাম্য রেখেই চলতে হবে।

সংলাপে ভারতের দিকে অংশগ্রহণ করেন সাবেক সহকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও কূটনীতিবিদ পঙ্কজ শরণ, ঢাকায় এর আগে ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আসা ভিনা সিক্রি ও রিভা গাঙ্গুলি দাস, ভারতে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (ও বর্তমান বিজেপি এমএলএ) অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ী, অনন্ত অ্যাসপেন সেন্টারের সিইও তথা টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাবেক কূটনৈতিক সম্পাদক ইন্দ্রানী বাগচী, বিবেকাননন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সাবেক সিনিয়র ফেলো তথা ওপি জিন্দাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত, দিল্লির মনোহর পারিক্কর আইডিএসএর সিনিয়র ফেলো ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ স্ম্রুতি পট্টনায়ক, স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ সুবিমল ভট্টাচার্য, দিল্লির থিংকট্যাংক আরআইএসের অধ্যাপক প্রবীর দে-সহ আরও অনেকে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের হয়ে সংলাপে অংশ নেন ড. ফাহমিদা খাতুন (নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি), ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, (সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি), অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান (সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি), মো. শহীদুল হক, (সাবেক সিনিয়র সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন (সাবেক নির্বাচন কমিশনার), ড. আমেনা মহসিন (অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), ড. ম. তামিম, (অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) এবং শামস মাহমুদ (সভাপতি, বাংলাদেশ-থাই চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি)। 

সংলাপে সমাপ্তি ভাষণ দেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তথা বর্তমানে জি-টোয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনের চিফ কো-অর্ডিনেটর হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক গত কয়েক বছরে অনেক উন্নত হয়েছে

ধারে ও ভারে দুপক্ষের প্যানেল এতটাই শক্তিশালী ছিল যে এই সংলাপের আলোচনা কেন দিল্লি ও ঢাকাতে এত গুরুত্ব পেয়েছে, তা অনুমান করা মোটেও কঠিন কিছু নয়। এই সংলাপে কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) নানা বিষয়ের পাশাপাশি বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি ও নিরাপত্তাগত নানা বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

জানা গেছে, দুদেশের বক্তারা একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক গত কয়েক বছরে অনেক উন্নত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর পূর্ণ সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে হলে আরও কতগুলো কাজ শেষ করতে হবে। এটাকেই বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন ‘লাস্ট মাইল ইমপ্লিমেন্টেশন’, অর্থাৎ একেবারে শেষ পর্বটুকুর বাস্তবায়ন। এটার অভাবেই বন্ধুত্বের পুরো ফায়দা তুলতে পারছে না দুই দেশ।

সীমান্ত বাণিজ্য
বাংলাদেশের বক্তারা বলেন, এখনও এক দেশের ট্রাক পণ্য নিয়ে অন্য দেশে মাল খালাস করতে গেলে লরিচালককে অন্তত ৫৫টা সই করিয়ে চেকপোস্টে দেখাতে হয়। এর ফলে অনেক সময় লরির মাল পচে যায়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অযথা দেরি হয়। ভারতীয় বক্তারাও স্বীকার করেন, সীমান্তে অত্যাধুনিক ‘ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট’ (আইসিপি) তৈরি হলেও চেকপোস্ট থেকে যে রাস্তা, সেটার হাল অনেক সময়ই খুব খারাপ। অর্থাৎ ধরা যাক বেনাপোল-পেট্রাপোলে দারুণ আইসিপি হলেও বনগাঁ থেকে কলকাতা পর্যন্ত রাস্তার হাল খুবই করুণ। লরিচালকরা বহু ক্ষেত্রেই পার্কিং মাফিয়াদের হাতে জিম্মি।

এই পরিস্থিতির অবসানে মৌলিক পরিবহন অবকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি পরের ধাপে যে একটি মোটর ভেহিকেল এগ্রিমেন্ট করতেই হবে, সে বিষয়ে দুই দেশের প্রতিনিধিরা একমত হন। বস্তুত কোভিডের সময় থেকেই বাণিজ্যিক লেনদেনের অনেক বিষয় ‘ডিজিটালাইজড’ হয়েছে, এখন একটি পূর্ণাঙ্গ যান চলাচল চুক্তি সম্পাদিত হলে পুরো পেপারওয়ার্কটাই ডিজিটালি করা সম্ভব হবে। এক দেশের পণ্য সীমান্ত দিয়ে অবাধে অন্য দেশে যেতে পারবে।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দিল্লির কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাচ্ছে না ঢাকা, সংলাপে এই অনুযোগও শোনা গেছে

তবে এর পাশাপাশি ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা এটাও মনে করিয়ে দেন, হাজারো বাধা সত্ত্বেও ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ কিন্তু মাত্র চার বছরের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৯ সালেও ভারতে বাংলাদেশের রফতানির মোট মূল্য ছিল ১০০ কোটি (১ বিলিয়ন) ডলার, সেটা ২০২২ সালের মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও ১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা দুদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
 
যোগাযোগের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে ঢাকা-গৌহাটি, চট্টগ্রাম-আগরতলা এবং সিলেট-দিল্লির মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল চালু করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। সংলাপে প্রস্তাব আসে, বাংলাদেশ বিমান ও এয়ার ইন্ডিয়া নিজেদের মধ্যে ‘ফিফথ ফ্রিডম রাইট’ সম্প্রসারিত করুক, ফলে এই দুটি এয়ারলাইন তৃতীয় কোনও দেশ থেকে যাত্রীদের এনেও উভয় দেশে নিয়ে যেতে পারবে।

বাংলাদেশে বসবাসকারী লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে যাতে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা যায়, সে ব্যাপারে ঢাকা যে দিল্লির কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাচ্ছে না, সংলাপে এই অনুযোগও শোনা গেছে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধির কাছ থেকে।

জবাবে ভারতের পক্ষে বক্তারাও জানিয়েছেন, ভারত এ ক্ষেত্রে ঠিক কীভাবে সাহায্য করছে এবং কোথায় কোথায় তাদের সীমাবদ্ধতা বা বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

/এনএআর/
সম্পর্কিত
কুনমিংয়ে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ত্রিদেশীয় বৈঠকে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ
ট্রাম্পের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন মোদি, জানালেন কারণ
রোহিঙ্গা-বাঙালি মানসিক ‘দ্বন্দ্ব’ কমবে?
সর্বশেষ খবর
গাজীপুরে পলিথিন কারখানায় টাস্কফোর্সের অভিযান, কারাদণ্ড ও মামলা দায়ের
গাজীপুরে পলিথিন কারখানায় টাস্কফোর্সের অভিযান, কারাদণ্ড ও মামলা দায়ের
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা জানালেন ট্রাম্প
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার কথা জানালেন ট্রাম্প
নেই ইডিএস স্ক্যানার, ধার করে কার্গো ফ্লাইট চালুর ভাবনা
নেই ইডিএস স্ক্যানার, ধার করে কার্গো ফ্লাইট চালুর ভাবনা
কানাডায় বাংলাদেশি নারীর মৃত্যু: ৮ মাসেও খোলেনি রহস্যের জট
কানাডায় বাংলাদেশি নারীর মৃত্যু: ৮ মাসেও খোলেনি রহস্যের জট
সর্বাধিক পঠিত
ট্রাম্পের সমালোচনার পর ইরান নিয়ে সুর পাল্টালেন তুলসি গ্যাবার্ড
ট্রাম্পের সমালোচনার পর ইরান নিয়ে সুর পাল্টালেন তুলসি গ্যাবার্ড
ট্রাম্পের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন মোদি, জানালেন কারণ
ট্রাম্পের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন মোদি, জানালেন কারণ
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র, মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট মানছেন না ট্রাম্প
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র, মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট মানছেন না ট্রাম্প
‘জুলাই যোদ্ধাকে’ মারধরের অভিযোগে এসআই বরখাস্ত
‘জুলাই যোদ্ধাকে’ মারধরের অভিযোগে এসআই বরখাস্ত
থানায় থাকা ট্রাঙ্কের তালা খুলে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র
থানায় থাকা ট্রাঙ্কের তালা খুলে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র