২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে যখন ২৭ মার্চ দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে হরতাল পালনের ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল, তখনও জানা ছিল না কী ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা করে সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিমান ঢাকা ত্যাগ করেছে। কেউ তখনও জানেন না যে, চরম বিশ্বাসঘাতকদের নজির রাখার নির্দেশ দিয়ে গেছেন তিনি।
২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বাঙালি অতিবাহিত করে এমন ভয়ানক রাত যা আগে কখনও আসেনি। শুরু হলো বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে করা পরিকল্পিত সামরিক অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন। তবে হানাদার বাহিনী তখন জানতো না একইসঙ্গে সূচনা হতে যাচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিরোধের শেষ ধাপ।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা ও দালিলিক প্রমাণ বলছে- এটা শুধু বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমনের একটি সামরিক না, এক গণহত্যার নীলনকশা যার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বেশ আগেই, একাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত সাংবাদিক রবার্ট পেইনের ‘ম্যাসাকার’ বইতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এক সামরিক বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের খতম করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সেনা বৈঠকে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, ‘কিল থ্রি মিলিয়ন অব দেম, অ্যান্ড দ্য রেস্ট উইল ইট আউট অব আওয়ার হ্যান্ডস।’
কী ছিল সেসময়ের পরিপ্রেক্ষিত? ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ফলে বাঙালিরা আশা করেছিল ক্ষমতার পালাবদল হবে এবং আওয়ামী লীগ ৬দফা অনুসারে সরকার গঠন করবে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) এর জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনা ও চাপে জাতীয় বিধানসভার কার্যাবলী মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করে দেন। বাঙালির বুঝতে সমস্যা হয় না, এবারের সংগ্রামই মুক্তির সংগ্রাম। আর জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে যখন স্বাধীনতার ডাক ও নির্দেশনা দিয়ে দেন তখন শুরু হয় প্রস্তুতি। আর এই প্রস্তুতিতেই প্রতিরোধকারীদের মানসিক সামর্থ্য গুড়িয়ে দিতে পরিকল্পনা হয় ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের।
‘অপারেশন সার্চলাইট’র প্রথম পর্যায় শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, একই সঙ্গে আক্রমণ চালানো হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও সিলেটে। পরবর্তী ৯ মাসে দেশের এমন কোনও স্থান ছিল না, যেখানে বাঙালি নিধন করে পাকিস্তানি সেনারা লাশ নদীতে ভাসায়নি বা গণকবর দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে বাংলাদেশের গণহত্যাকে অন্যতম ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী আর জে রুমেল। তিনি তার ‘ডেথ বাই গভর্নমেন্টস’ বইতে লিখেছেন, ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা প্রতি ২৫ জন বাঙালির একজনকে হত্যা করেছে।
আর এই হত্যাযজ্ঞের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আঘাত ছিল ২৫ মার্চ রাতে। কারণ বাঙালি স্বপ্নেও ভাবেনি এই বর্বরতার কথা। রাত তখন ১১টা ৩০ মিনিট। ট্যাঙ্ক ও সৈন্যভর্তি ট্রাকগুলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরুর উদ্দেশ্যে। জিরো আওয়ার বা আঘাত হানার সময় ছিল রাত ১টা।
হানাদার বাহিনী ফার্মগেটের সামনে এলেই পিকেটারদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পিকেটারদের হটানোর জন্য জিরো আওয়ারের অপেক্ষা না করেই গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’। অপারেশন শুরুর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই কর্নেল জেড এ খান ও মেজর বিল্লাল স্বাধীনতার স্থপতি, অবিসংবাদিত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসা থেকে তুলে ক্যান্টনমেন্ট এবং ৩ দিন পর তাকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়।
২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক, রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় ইপিআর সদস্য বাঙালি জওয়ানেরা। আর পাশাপাশি টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও, টেলিগ্রাফসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ধ্বংস করে দেওয়া, যাতে ঢাকাকে শতভাগ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। এসব উদ্দেশ্য সফল করার জন্য পাকিস্তানিরা ওই রাতে মেশিনগানকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নেয়। যার ফলে ২৬ মার্চ রাজধানীর মানুষ দেখেছিল ধ্বংসস্তুপ আর লাশের স্তুপ। রবার্ট পেইনের মতে, অভিযানের প্রথম রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়।
/এএইচ/
/আপ-এএ/