X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে ৭৪ লাখ শিশু শ্রমিক!

জাকিয়া আহমেদ
১২ জুন ২০১৬, ০৭:৩১আপডেট : ১২ জুন ২০১৬, ০৭:৫২

২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) হিসাব করেছিল দেশে ৭৪ লাখ শিশু শ্রমিক কাজ করছে। আর এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে ১৩ লাখ শিশু। অপরদিকে, সরকারি হিসেবে এ সংখ্যা ১৫ লাখ। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বলছে, দেশে শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ৭০ লাখেরও বেশি শিশু। এর মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রমিক। সরকারিভাবেও ৪২টি কাজকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাসা-বাড়িতে গৃহশ্রমিকের কাজ, মোটর মেকানিক, ইট ভাঙার কাজে, ইটভাটায়, টেম্পু হেলপার, পাথর ভাঙা, পোশাক কারখানায়, লেদ মেশিন কারখানায়, ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ করেই চলেছে শিশুরা। ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে কোথাও কাজে দেওয়া যাবে না বলা হলেও সে নিয়ে মাথাব্যাথা নেই অভিভাবক এবং নিয়োগকর্তার। আর এভাবেই দেশে বেড়ে চলেছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা।

শিশু শ্রমিক

কাঁঠালবাগান ঢালে কথা হয় কুলসুম নামের এক মায়ের সঙ্গে। জানালেন চার মেয়ের পর ছেলের আশায় আবার সন্তান নিলে পঞ্চম সন্তানটিও হয় কন্যা। কন্যার জন্মের পরপরই ট্রাকচালক স্বামী বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। এখন এই ছয় সদস্যের পরিবারকে দেখতে হয় কুলসুমকেই। কাঁঠালবাগানেই ইট ভাঙার কাজ করেন তিনি। তবে এখন সঙ্গে যোগ হয়েছে ১২ এবং ৯ বছরের মেয়ে দু’টিও। কিন্তু এ বয়সী শিশুকে তো কাজ করতে মানা করছে সরকার। কুলসুমকে এ কথা বলতেই তার ঝাঁঝালো জবাব,আপনার সরকারকে বলেন,আমাদের দিনের খাওয়া দিতে,মাইয়াগো কাজ করাইতে আমারও ভালো লাগে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,কেবল আইন  প্রণয়ন করলেই চলবে না-শিশু শ্রম বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল দেশ থেকে শিশু শ্রম নিরসন হবে। আর শিশু শ্রমে নিয়োজিত শতকরা ৫৭ ভাগ শিশু মারধরের শিকার হয় বলে জানা গেছে এক গবেষণা প্রতিবেদনে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি,বয়স্ক শ্রমিকদের কাজের অভাব, ন্যূনতম মজুরি না পাওয়া, মানসম্মত শিক্ষার অভাব,আইনি বিধান ও প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, শিশুর পরিবার ও কাজে নিয়োগদাতাদের মধ্যে শিশু শ্রমের নেতিবাচক দিক না জানাকেই শিশু শ্রমের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শ্রমআইন ২০১৩ ও জাতীয় শিশু শ্রম নিরসন নীতি ২০১০ অনুযায়ী ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে কোনও কাজে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং ১৮ বছরের নিচের কোনও শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এ নিষেধাজ্ঞার প্রয়োগ দেশে নেই বলছেন তারা।

দেশে বর্তমানে ১৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। একইসঙ্গে  তিনি জানিয়েছেন ২০২১ সালের মধ্যে এই ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম নিরসন করা হবে। মন্ত্রী বলেন,দেশে ৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মধ্যে ৩৮ টি কাজকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই ৩৮ কাজে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ১২ লাখের বেশি শিশু। তবে ৬০ হাজার শিশুকে ৪ বছর মেয়াদি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আরও ৫০ হাজার শিশুকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুনর্বাসনের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী বলেন,শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে শিশু শ্রমের বিষয়ে সচেতন হবে হবে। কারণ,শিশু শ্রম বন্ধে দেশে আইন থাকলেও সচেতনতার অভাবে অনেক ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ হয় না। অপরদিকে শিশশ্রমকে একটি বহুমাত্রিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ।  তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশু শ্রম বন্ধে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে একটি সাধারণ প্রচারণা যদিও চলছে, তবে সেক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ খুব বেশি নেওয়া হচ্ছে না। গ্রাম এবং উপজেলা পর্যায়ে যদি শিশুদের থাকা খাওয়ার সুরক্ষাসহ বিদ্যালয় এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যৌথভাবে পরিচালিত না হয় তাহলে শিশু শ্রম বন্ধ করা খুব কঠিন। এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ যা কিছু রয়েছে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সীমিত। শিশু শ্রমে নিয়োজিত যেসব শিশু রয়েছে তাদের জন্য বাজেটে আরও বরাদ্দ থাকা উচিত ছিল, যেন প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিদ্যালয় এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেটিও হয়নি। আর এরকম কোনও সরকারি উদ্যোগও আমরা দেখছি না বলেন সুলতান উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দুস্থ শিশুদের নিয়ে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের যেসব প্রকল্প রয়েছে সেগুলো সুদূরপ্রসারী কোনও লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে বলে আমার মনে হয় না। কোনও পরিবার যদি দুস্থ হয় তাহলে সেই পরিবারটি তার সন্তানকে এখানে পাঠাতে পারবে,শিশুটি এখানে তার মৌলিক চাহিদা সব পাবে এবং ভবিষ্যতের জন্য একজন দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে এমন কিছু এখানে নেই।

শিশু শ্রমিক

দ্বিতীয়ত,শিশু শ্রম নিরসনে দেশে যে আইন রয়েছে সেই আইন বাস্তবায়নে কেউই আমরা আন্তরিক নই। ১৫ বছরের নিচে কোনও শিশুকে কোথাও নিয়োগ দেওয়া যাবে না এবং ১৮ বছরর নিচে কোনও শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হবে না-এই আইনের প্রয়োগ আমরা কোথাও দেখি না। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের ক্ষেত্রে যদি আইনের প্রয়োগ না হয় তাহলে শুধু প্রচারণা বা প্রকল্প দিয়ে শিশু শ্রমরোধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও আইনের প্রয়োগ হতে হবে যথাযথ। যারা এই আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন তাদেরকে এ ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে।

অপরাজেয় বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, ২০১১ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০১৩ সালে প্রকাশিত এক জরিপ থেকে জানা যায়,দেশে মোট শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। জরিপ প্রকাশের পর কেটে গেছে আরও তিন বছর। কোথাও কোথাও হয়তো এ অবস্থার উন্নতি হয়েছে আবার কোথাও হয়তো উন্নতি হয়নি। গার্মেন্ট কারখানায় শিশু শ্রম নিষিদ্ধ হলেও সেখানে এ বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত, কৃষিকাজে, সমুদ্রে মাছ ধরার কাজে, শুঁটকি ব্যবসায়,জাহাজ ভাঙার কাজে যেসব শিশুরা রয়েছে তারাও এই জরিপে অর্ন্তভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। ঝুঁকিপূর্ণশ্রমের সঙ্গে যেসব শিশু জড়িত তাদেরকে এসব কাজ থেকে তুলে আনতে হবে,তাদের জীবনে একটি পরিবর্তন আনতে হবে যার মাধ্যমে সে পরবর্তী জীবনের সুন্দর স্বপ্ন দেখবে।

ছবি: মাহমুদ ওমর ফারুক

/এমপি/ এমএসএম /

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রুমায় জঙ্গলে পড়ে ছিল গুলিবিদ্ধ দুই মরদেহ
রুমায় জঙ্গলে পড়ে ছিল গুলিবিদ্ধ দুই মরদেহ
বনানীতে বাসচাপায় আহত মোটরসাইকেলের চালক মারা গেছেন
বনানীতে বাসচাপায় আহত মোটরসাইকেলের চালক মারা গেছেন
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিএনপির লজ্জা পাওয়া উচিত: কাদের
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিএনপির লজ্জা পাওয়া উচিত: কাদের
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
সর্বাধিক পঠিত
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে