গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলাসহ সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বড় ধরনের সহিংসতার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। বাংলা ট্রিবিউন আয়োজিত ‘গুলশান হামলা, দুর্বলতা কোথায়?’ শীর্ষক বৈঠকিতে জঙ্গিদের কলা-কৌশল ও পুলিশের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেন বক্তারা। তাদের মতে, জঙ্গিরা সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে, কারণ তাদের হত্যা করলে নিউজ হবে। অন্য কাউকে মারলে এটা হতো না। জঙ্গিদের কৌশল বা আইডোলজি দেখলে এটা পরিষ্কার যে তারা আসলে বড় কিছু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর্টিজানে হামলা মোকাবিলায় পুলিশের প্রস্তুতি ছিল না বলেও মন্তব্য করেন তারা।
বৈঠকিতে অংশ নেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন, মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা সোহেল মাহমুদ, সাংবাদিক উদিসা ইসলাম ও বাংলা ট্রিবিউনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেল। বৈঠকি সঞ্চালনা করেন মিথিলা ফারজানা।
গুলশানের ঘটনা মোকাবিলায় পুলিশের কোনও প্রস্তুতি ছিল না বলেও মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, জঙ্গিরা এমনকি ইউটিউবের মতো ভিডিওসাইটগুলো দেখেও সেলফ রেডিক্যালাইজড হচ্ছে। যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলোর চিত্রায়ণ করলে তাদের আদর্শের ভিত্তি পাওয়া যাবে।
বৈঠকিতে তিনি বলেন, মুকুন্দ দাস একজন মুদি দোকানদার। তাকে কেন হত্যা করা হবে? কারণ মুকুন্দ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাকে হত্যা করলে একটা নিউজ হবে। অন্য কাউকে মারলে এটা হতো না। জঙ্গিদের কৌশল বা আইডোলজি দেখলে এটা পরিষ্কার যে তারা আসলে বড় কিছু করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সাখাওয়াত হোসেন যোগ করেন, আর্টিজানে হামলার আগে আমি টকশোতে বলেছিলাম বড় কিছু হবে। বাংলাদেশে ২০/৩০ জন সিরিয়াতে আইএসর-এর সঙ্গে আছে। ইঙ্গিত থাকার পরও কেন এমন একটা ঘটনা ঘটবে। গুলশানের ঘটনা মোকাবিলায় পুলিশের কোনও প্রস্তুতি ছিল না। হ্যাঁ, আমাদের দেশে আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি, সে জন্য প্রস্তুত থাকব না এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু সে সম্পর্কে পড়েছি। মুম্বাই হামলায় ১০ জন জঙ্গি শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে কিভাবে সেটা করেছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে।
অন্য একটি প্রসঙ্গে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) সাখাওয়াত বলেন, 'যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে তাদের অনেকে হয়তো জায়গা খুজছে কিভাবে কামব্যাক করা যায়, তাদের সাহায্য করতে হবে। অনেকে হয়তো অন্য স্বপ্ন নিয়ে এ পথে গেছে। স্বপ্নভঙ্গের কারণে সে ফিরতে চায় তাকেও সুযোগ করে দিতে হবে।
মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশিদ বলেন, ধর্ম বিষয়ে নিরক্ষররাই জঙ্গিদের টার্গেট হয়ে উঠছে। এদেরকে মোটিভেট করা সহজ। বাংলা ট্রিবিউনের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জুলফিকার রাসেলের দায়ী কারা বা দায় কার বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের সাপ যদি আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসে তবে গর্ত কোথায় এই প্রশ্ন সবার। এটা খুঁজতে গেলে আপনি যদি বলেন আমি জানি না। আমার দায় নেই। এই যে দায় অস্বীকারের একটা ফ্যাক্টর কাজ করছে এটা বড় ফ্যাক্ট। এই এই ডিনায়ালে বাস করার ঝুঁকিটা সবচেয়ে বড়।
নিবরাস যেখান থেকে জঙ্গি হয়েছে সে পথটা যদি বন্ধ না করা যায় তবে এই ঝুঁকিটা থেকেই যাবে। চোর পালারে বুদ্ধি তো বাড়বেই্ চুরি হওয়ার পর দুর্বলতা ফাঁক ফোকর বের করতে পারবেই। তবে সেসব ফাঁক ফোকর বের বন্ধ করতে পারলেই ঝুঁকিটা কমবে।
আইনও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, আমরা একটি যুদ্ধের মধ্যে আছি। এটি মোকাবিলা করতে হলে রাষ্ট্রকে সচেতন হতে হবে। এখানে রাষ্ট্র বলতে সবাই। শুধু খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা নয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, সম্প্রতি জঙ্গিরা যাদের সহযোদ্ধা বানানোর টার্গেট করছে, খুব চালাকির সঙ্গে তাদের নির্বাচন করছে। সেসব পরিবারের সন্তানদের টার্গেট করছে যারা সমাজের ক্ষমতার কাছাকাছি আছে। এমনকি তারা যেসব বাড়ি ভাড়া করে কার্যক্রম চালাচ্ছে তারাও ক্ষমতার কাছকাছি। তারা এসব স্থান ব্যবহার করছে কারণ তারা এখানে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবে। এখানে কে কোন দলের সেটা দেখার সুযোগ নেই।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ব্লগার হত্যা থেকে শুরু করে সম্প্রতি গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা একই গ্রুপের কাজ। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের ময়নাতদন্ত করেছি আমি। ব্লগার হত্যা থেকে গুলশান হামলা প্রত্যেকটি আঘাতই একই টাইপের। সুতরাং এতে বলাই যায় হত্যাকারী একটি গ্রুপেরই।
তিনি আরও বলেন, আর্টিজানে নিহতদের ময়নাতদন্তে দেখা গেছে রাত ১২টার আগেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জঙ্গিরা ২০ জনকে জবাই হত্যা করেছে। হত্যার শিকার হওয়া ইতালিয়ানরা দীর্ঘদেহী। তাদের হত্যা করতে চরম অমানবিক শক্তি প্রয়োজন।'
ডা. সোহেল বলেন, গুলশানে যে জঙ্গিরা ছিল তারা আর্টিজানের দেয়ালে লিখে গেছে 'উই আর গোয়িং টু জান্নাত।' আরেক জায়গায় লেখা ছিল ' পুলিশ স্যাড নিউজ ওয়েটিং ফর ইউ'। এদের এমনভাবে বুঝানো হয়েছে ব্লগার বা বিদেশিরা ইসলামের শত্রু। এভাবেই তাদের মোটিভেট করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার , এই যে তাদের নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করার কাজ করছে তরুণরা, এটা তারা কীভাবে করছে এটার অনেক রকম ব্যাখা আছে। এখন যে ড্রাগের কথা বলা হচ্ছে এটার বড় একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু তারা ড্রাগ নেবে কেন? এদের ব্রেনওয়াশড করা হয়। জঙ্গিরা যখন ট্রেইনড হয় তখন তাদের শেখানো হয় আমরা ইসলামের সেবক। একটি শ্রেণিকে মেরে ফেলাকে পবিত্র দায়িত্ব বলে তাদের বুঝানো হয়। এটা করলে তারা বেহেশতে যেতে পারবো বলে বুঝানো হয়। আসলে তাদের মোহমত্ত হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, যারা হামলা করছে এরা বেশ দীর্ঘসময় জঙ্গিদের সঙ্গে ছিল না। দেখা গেছে এরা ৩ মাস বা ছয় মাস ধরে জঙ্গি সম্পৃক্ততায় জড়িত ছিল। আমাদের সমাজ বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে এই বিভক্তি যতই বাড়বে ততই সমস্যা বাড়বে।
পুলিশ বা গোয়েন্দা বাহিনীর দায়িত্ব ও সরকার কি পদক্ষেপ নিচ্ছে, কি তদন্ত হচ্ছে এ প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনের জেষ্ঠ্য সাংবাদিক উদিসা ইসলাম বলেন, সন্দেহভাজন বলে ধরা হয়েছে কাদের। এই প্রশ্নের উত্তর জনসাধারণের সামনে আসা উচিত। তাদের পরিচয় প্রকাশ করা দরকার। পুলিশ যদি স্পষ্টভাবে জানায় তাহলে কোনও গুজব ছড়ানোর সুযোগ নেই। এটা স্পষ্ট করলে, আমরা জানতে পারতাম সন্দেহভাজনরা পুলিশ হেফাজতে আছেন। তাদের পরিবারও জানতে পারতো।
/এমআর/এফএএন/