X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘তুইও মরবি, আমাদেরও মারবি’

উদিসা ইসলাম
২৫ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৪৬আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৫৯

এ এফ এম  ‍মুহিতুল ইসলাম
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী এ এফ এম  ‍মুহিতুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার রাতে ৩২ নম্বরের বাড়িতেই  ছিলেন। কোনোভাবে বেঁচে যাওয়া কয়েকজনের মধ্যে তিনি একজন।। ১৯৭৫ এর ঘটনার পর একাধিকবার গিয়েছেন মামলা করতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। অবশেষে ১৯৯৬ সালে তার দায়ের করা মামলার সূত্র ধরেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পাওয়া যায় ২০১০ সালে এসে। আজ  বৃহস্পতিবার এক সমুদ্র ইতিহাসের সাক্ষী মুহিতুল ইসলাম মারা যান।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর নিজের অনুভূতি জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন, ৭৬ সালের ২৩ অক্টোবর একবার চেষ্টা করেছিলাম। সরকারের অনুমতি ছাড়াই লালবাগ থানায় গিয়েছিলাম মামলা করতে। এজাহারের বিবরণ শুনে ডিউটি অফিসার গালে এক চড় কষিয়ে বললেন, ‘তুইও মরবি, আমাদেরও মারবি।’

এই সেই ব্যক্তি যিনি বিচারের আশায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনায় মামলা করেছিলেন। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি মামলা চলাকালে আদালতে বলেছিলেন, ‘আমার ধারণা ছিল ঘাতকরা অন্তত শিশু রাসেলকে হত্যা করবে না, সেই ধারণাতেই আমি রাসেলকে বলি ‘না ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’ সেসময় বর্তমানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ছিলেন না, ফলে যে কয়েকজনের জবানিতে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানা যায়, তার মধ্যে মুহিতুল একজন।

বাদী হিসেবে আদালতে দাঁড়িয়ে মুহিতুল বলেছিলেন, গেটে অবস্থানরত মেজর বজলুল হুদাকে মেজর ফারুক কী যেন জিজ্ঞাসা করেন, তখন মেজর বজলুল হুদা বলেন ‘অল আর ফিনিশড’।বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবার আমৃত্যু ত্যাগ নির্ভীকতার সাথে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ খুনিদের কাছে প্রাণভিক্ষা চান নি, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখে খুনিদের বলেছেন ‘তোমরা এখানেই আমাকে মেরে ফেল।’

২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষা করতে জারি করেন ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। ১৯৭৯ সালে এই অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে বিএনপি সরকার অনুমোদন দিলে ১৪ আগস্ট ১৯৯৬ এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা বা এর বিচার নিয়ে কোনও কথা হয়নি।২ অক্টোবর ১৯৯৬ ধানমণ্ডি থানায় এফআইআর   দায়ের করেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী মুহিতুল ইসলাম। তবে সেটাই প্রথম না। এর আগেও চেষ্টা করেছিলেন মামলা করতে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সব জায়গা থেকে যখন মুছে ফেলা হচ্ছে তার অবদান, ঠিক তখন অক্টোবর মাসে তিনি গিয়েছিলেন মামলা করতে।

এ এফ এম  ‍মুহিতুল ইসলাম ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর যন্ত্রণার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, রাত থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত জীবিতদের সবাইকে ৩২ নম্বরে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। নানাভাবে আহতদের শরীর রক্তাক্ত থাকলেও মুহিতুলসহ কেউই রক্ষা পাননি। পরে আর্মির গাড়িতে করে তাদের ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয়। পাহারাদারের চোখ এড়িয়ে তিন দিন পর ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ার্ডের পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে যান তিনি।আবার ধরাও পড়েন।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা করার পর থেকে পুলিশের পাহারায় থাকলেও ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ তুলে নেওয়া হয়েছিল। শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। ’৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত যে দুঃসহ দিন কাটিয়েছেন, পরবর্তীতে ২০০১ সাল থেকেও সেই একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এই মানুষটিকে। বেশিরভাগ সময় আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ বাড়িতে অচেনা লোকজন খুঁজতে আসত।

১৯৭৫ এর সেই ভয়াবহ স্মৃতি হাতড়ে তিনি জানিয়েছিলেন পুরো দেশকে। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র জমা দিতে এলে চাকরি পেয়ে যান শাখা সহকারী হিসেবে।

তিনি বলেন, মুখ্য সচিবের অফিস থেকে একটি ফাইল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যেতেই তিনি আমাকে পছন্দ করেন এবং তার বাসভবনে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে ৩২ নম্বরের জন্য নিয়োগ দিলেন। কাজ ছিল রাষ্ট্রপতির পক্ষে ফোন ধরা আর প্রটোকল করা। বাসার মিস্ত্রি মতিন আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলে, প্রেসিডেন্ট ডাকছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধু নিজেই নিচে নেমে আসেন। বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ ফোনটিও আমিই ধরিয়ে দিয়েছিলাম।

শেখ কামাল নিচে নামতে না নামতেই কয়েকজন ঘাতক বাড়ির ভেতরে ঢোকে। কিছুক্ষণের ভেতরে তাদের ব্রাশফায়ারে নিথর হয়ে যায় তার দেহ। ওই গুলিতে আমি এসবির এক দারোগাসহ কয়েকজন আহত হই। ঘাতকেরা আমাদের চুল ধরে টেনে লাইনে দাঁড় করায়।

লাইনে দাঁড়ানোর সময়ই রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। জানতে চায় ‘ভাইয়া, ওরা আমাকে মারবে না তো।’ আমি তাকে অভয় দিই। আমার মনে হয়েছিল এই অবুঝ শিশুকে হয়তো রেহাই দেবে।তখন সে মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল। একজন ঘাতক তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি বলে তাকে গুলি করে।

১৯ নভেম্বর ২০০৯, হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পাঁচ আসামির আপিল আবেদন খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। আদালতের চূড়ান্ত রায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। ২০১০ সালে ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মুহিউদ্দিন আহমদ, বজলুল হুদা এবং একেএম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

এপিএইচ/

আরও পড়ুন:

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী মুহিতুল ইসলাম আর নেই

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফোরাম থেকে ব্যারিস্টার খোকনের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার
ফোরাম থেকে ব্যারিস্টার খোকনের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার
সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান সিদ্দিকীর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার
সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান সিদ্দিকীর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী বৃহস্পতিবার
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
সর্বাধিক পঠিত
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
ফালুর বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন
ফালুর বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট অনুমোদন