চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আসন্ন ঢাকা সফর বাংলাদেশের জন্য বড় সম্ভাবনা বয়ে আনবে বলে মনে করছেন বিশিষ্ট শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাবেক কূটনীতিকরা। তাদের মতে, সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প বিষয়ে আলোচনা করতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। এ জন্য স্মার্ট ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের সুযোগ নিতে হবে। সোমবার দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ আহ্বান জানান।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যেসব প্রকল্পের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সেগুলোর বিষয়ে আলোচনা সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে কোনও ভুল করলে অনেক খেসারত দিতে হবে। কারণ এসব প্রকল্পের অর্থ আমাদের ফেরত দিতে হবে।’
শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তাদের বড় দুটি প্রকল্পে চায়না অর্থায়নের কারণে তাদের বিদেশি ঋণের বোঝা অনেক বেড়ে গেছে।’ বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘আমরা বছরে ৪৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি ও রেমিট্যান্স থেকে পাই। বিদেশি ঋণ পরিশোধ করি এক বিলিয়ন ডলারের মতো। ফলে আমরা অনেক বেশি-বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা রাখি কিন্তু এই ঋণের আলোচনা আমাদের সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে।’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান বলেন, ‘প্রকল্প আলোচনার সময়ে এর শর্তাবলির বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘প্রকল্প কে বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্প নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য যা-যা করা দরকার, সেটি করতে হবে কারণ এ বিষয়ে আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না।’ তার মতে, ‘চীনের রাষ্ট্রপতির সফর বাংলাদেশের প্রতি তাদের আগ্রহের বিষয়টি ইঙ্গিত করে।’
বাংলাদেশ যে পরিমাণ গ্রহণ করতে পারবে চীন, ততটুকু সহায়তা বাংলাদেশকে দেবে বলে ফারুক সোবহান বলেন, ‘চীনের নতুন দুটি উদ্যোগ—‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ ও ‘এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক’-এর বাংলাদেশ অংশীদার। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের মতের মিল-অমিল আছে। গত সাত বছর ধরে তারা সন্ত্রাসবাদবিরোধী মহড়া করছে এবং সন্ত্রাসবাদ তাদের দু’দেশের জন্যই সমস্যা। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বড় প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুষ্ঠু কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যহাত রাখা।’
ফারুক সোবহান বলেন, ‘চীন ও ভারত উভয়ই কানেক্টিভিটির জন্য আফগানিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার বিষয়ে আগ্রহী। সার্ক ছাড়া এ বিষয়টি সম্ভব নয়।’
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড বৃহৎ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি ধারণা। আমরা এই বৃহৎ যোগাযোগে যোগ দেব কিনা, তা আমাদের বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এ যোগ দিলে অন্য কোনও কানেক্টিভিটি উদ্যোগে যোগ দিতে বাংলাদেশের কোনও বাধা নেই।’ চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়—এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন ‘প্রকল্পের শর্তাবলি মেনে চললে খরচ অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার সুযোগ নেই।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত বলেন, ‘প্রকল্প আলোচনার সময়ে নির্ধারিত শর্তাবলির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশে বেশিরভাগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এ কারণে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘অস্বাভাবিক ব্যয় শুধু চীনের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও ঘটে।’ যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এর খরচ মাত্র পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।’
আইনুন নিশাত বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনীহা। এ কারণে বিদেশিরা আমাদের বিশ্বাস করতে চায় না।’ নিজের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘কয়েক বছর আগে একজন মন্ত্রীর সঙ্গে বেইজিং সফরের সময়ে দেখেছি, চায়না কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন তুলেছে, কয়েক বছর আগে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সেটি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি, তার কারণ কী।’
গোলটেবিলে বৈঠকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড স্টাডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মাহফুজ কবির এবং বিলিয়া-এর রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট নুর মোহাম্মাদ সরকার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম।
আরও পড়ুন: দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের নতুন বার্তা দেবেন চীনের প্রেসিডেন্ট
/এসএসজেড/এমএনএইচ/