X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বস্তিতে আগুন-উচ্ছেদ: রাজধানীতে এক বছরে লাখো উদ্বাস্তু!

উদিসা ইসলাম
২৮ জানুয়ারি ২০১৭, ২২:৪৯আপডেট : ২৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৮:২৯

আগারগাঁও বস্তি সাত বছর আগে নদীভাঙনে সব হারিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন গৃহকর্মী রাহেলা। তিন সন্তান নিয়ে তিনি কোনও রকমে থাকতেন কল্যাণপুর পোড়া বস্তিতে। ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি হঠাৎ বস্তি উচ্ছেদ হওয়ায় ঘর হারান তিনি। ক্ষতিপূরণের আশায় তিন দিন খোলা মাঠে ছিলেন, কিন্তু কিছু পাননি। জীবনে দ্বিতীয়বার ঘর হারিয়ে, তিন বাড়ির কাজ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন তেজকুনিপাড়া রেলপার।

ঘর হারানোর পরের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল রাহেলার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নতুন কাজ পেয়ে পরের মাসের বেতন পাওয়া পর্যন্ত সংসার খরচ ও ঘরের আগাম ভাড়া মিলিয়ে চল্লিশ হাজার টাকার ধাক্কা ছিল।

মহানগরীর বস্তিবাসী, শ্রমিক নেতা ও উন্নয়নকর্মীরা বলছেন, গত এক বছরে রাজধানী ঢাকায় আগুন বা ভিন্ন কারণে বস্তি উচ্ছেদের ফলে আভ্যন্তরীণ ‘শরণার্থী’ বা উদ্বাস্তুর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। তারা এক বস্তি থেকে নিঃস্ব হয়ে আরেক বস্তিতে জায়গা করে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু জীবনের মৌলিক কোনও অধিকার তাদের নেই।

দরিদ্র বস্তিবাসী উন্নয়ন সংস্থা (এনডিবাস) এর তথ্য অনুযায়ী, বস্তিতে উচ্ছেদ আর আগুনের কারণে গত এক বছরে লাখ খানেক মানুষ আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

কল্যাণপুর বস্তি রাজধানীতে গত এক বছরে চারটি বড় বস্তিতে একাধিকবার উচ্ছেদ হয়েছে বা আগুন লেগেছে। যে কারণে রাহেলার মতো গৃহহীন হয়েছেন লাখো মানুষ। কেউ নতুন  ঠিকানা খুঁজে পেয়েছেন, কেউ কোনও মতে অন্যের ঘরের এক কোণে জায়গা করে নিয়েছেন।

ঘরহারা বেশিরভাগ মানুষ রাত কাটানোর জন্য ফুটপাথ, ফুট ওভারব্রিজ বা পার্ক বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। সামান্য কয়েকজন কোনও মতে ফ্ল্যাট বাড়িতে বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন। তবে বাড়তি আয়ের জন্য তাদের দিতে হচ্ছে অক্লান্ত শ্রম। মাত্র একটি রুমের জন্য সাত হাজার টাকা বা তারও বেশি ভাড়া গুনতে গিয়ে দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

শ্রমিক ও স্বল্প আয়ের মানুষরা বলছেন, বস্তি উচ্ছেদের কারণে তাদের জীবন এলোমেলো হয়ে পড়ছে বারবার। রাজধানীর কল্যাণপুর বস্তিতে থাকা রিকশা চালক সুকুর আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকায় আসার পর থেকে এই বস্তি বারবার উচ্ছেদ হতে দেখছি। এলাকার ক্ষমতাবানরা বারবার টাকার বিনিময়ে ঘর তুলেছে, আমরা থেকেছি। কিন্তু কেউই আমাদের পুনর্বাসন করতে চাননি। যত দিন যাচ্ছে, বস্তির জায়গার দিকে ক্ষমতাবানদের নজর বাড়ছে। ফলে আগামীতে ঘরহীন মানুষের সংখ্যা বাড়বে।

কড়াইল বস্তি গত বছর মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে দু’বার বনানীর কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগে। গুলশান লেকের দুই পারে ১৫০ একরেরও বেশি জায়গায় গড়ে ওঠা এই বস্তিতে কয়েক লাখ মানুষের বাস। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের হিসাব অনুযায়ী, আগুনে কড়াইল বস্তির ৫০০রও বেশি ঘর পুড়ে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গৃহহীন হয় কয়েক হাজার মানুষ।

শুধু বনানী, কল্যাণপুর, আগারগাঁও, তালতলা এলাকা নয়, ঢাকা শহরের তিন শতাধিক বস্তিতে থাকা চল্লিশ লাখেরও বেশি মানুষকে নগর উন্নয়নের নামে উচ্ছেদের পরিকল্পনা চলছে বলে দাবি করছে বস্তিবাসীদের নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলো।

এ প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বস্তিগুলোতে নদীভাঙনের কারণে সহায়-সম্বলহীন মানুষ বেশি থাকে। হকার, পোশাক শ্রমিক, নিরাপত্তারক্ষী, গৃহকর্মীরা সাধারণত বস্তির বাসিন্দা। মনে রাখা দরকার, উচ্ছেদের কারণে এই নিঃস্ব মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু তাদের জীবনে কোনও ধরনের নিশ্চয়তা নেই। এরা শেকড় থেকে উৎখাত হওয়ার ফলে একটা বিচ্ছিন্ন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যা সামাল দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।

রাজধানী বস্তিবাসী ইউনিয়নের সংগঠক ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আহসান হাবিব লাভলু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, সব সরকারের আমলে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য বস্তিবাসীকে ব্যবহার করা হয়। এমনকি নিজের দলের মধ্যেও ক্ষমতার অদলবদল হলে বস্তি পোড়ানো হয় ও নতুন ঘর তুলে ব্যবসা করা হয়। কিন্তু এর ফলে রাজধানীতে আভ্যন্তরীন শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, ঘরহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, একথা আমরা বুঝাতে ব্যর্থ হচ্ছি যে, বস্তিবাসীরা ভাল পরিবেশে থাকলে নগরের স্বাস্থ্যও ভাল থাকবে। এরা প্রতিনিয়ত আমার-আপনার কাজে লাগছেন।

আহসান হাবিবের বিশ্বাস, গ্রামে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকলে ঢাকায় এ ধরনের মানবেতর জীবন যাপন করতে হতো না তাদের।

 

/এএআর/ আপ-এমডিপি/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জলবায়ু বিপর্যয় উপকূলীয় মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে: গবেষণা
জলবায়ু বিপর্যয় উপকূলীয় মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে: গবেষণা
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের বিকাশে সরকারের সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের বিকাশে সরকারের সহযোগিতা চান ব্যবসায়ীরা
‘উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে বেশি ভোটার উপস্থিতি থাকবে’
‘উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে বেশি ভোটার উপস্থিতি থাকবে’
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
সর্বাধিক পঠিত
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
সিএনজির রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চালু করতে বিআরটিএ অফিস ঘেরাও
সিএনজির রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চালু করতে বিআরটিএ অফিস ঘেরাও
চাকরি স্থায়ীর দাবিতে বিটিসিএল কর্মচারীদের ‘লাগাতার অবস্থান’
চাকরি স্থায়ীর দাবিতে বিটিসিএল কর্মচারীদের ‘লাগাতার অবস্থান’