X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেটের গাণিতিক হিসাব মিলবে কীভাবে?

শফিকুল ইসলাম
০৭ জুন ২০১৮, ২৩:৩৭আপডেট : ০৮ জুন ২০১৮, ১৭:২৫

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বিশাল বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি আয় ও ব্যয়ের হিসাবও মিলিয়েছেন; কিন্তু বাজেটের গাণিতিক হিসাব অর্থমন্ত্রী মেলাবেন কীভাবে—এ প্রশ্ন সংশ্লিষ্টদের।

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত কর থেকে আসবে দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। আর এনবিআর-বহির্ভূত কর বাবদ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে এনবিআরকে সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্য থেকে ৭১ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে; যা ওই অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্য থেকে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। কিন্তু এনবিআর কখনোই রাজস্ব আদায়ে এত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারেনি–এমন মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের।

সরকার এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর থেকে যে রাজস্ব আয় করবে তার মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট)। যদিও পৃথিবীতে এ চিত্র বিপরীত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী খাত হচ্ছে আয়কর। বাংলাদেশে এর অবস্থান দ্বিতীয়।

বরাবরের মতো এ বছরও সরকারকে মূসক বা ভ্যাট থেকে আদায় করতে হবে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব। এ খাতে এই বছর লক্ষ্য ধরা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। আর ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে এক লাখ ২০০ কোটি টাকা আয়কর এবং শুল্ক খাতে ৮৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে এনবিআরকে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ নেয়—যার মধ্যে বেশি নেওয়া হয় ব্যাংক খাত থেকে। ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেও বড় অঙ্কের টাকা সংগ্রহ করা হয়।

সরকার আয়কর থেকে রাজস্ব বাড়ানোর নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এরমধ্যে নতুন করদাতার সন্ধানে নেমেছে এনবিআর। আগে যেখানে ৭ থেকে ৮ লাখ মানুষ ট্যাক্স দিতো, সেখানে বর্তমানে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা ৩২ লাখে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যদিও আমাদের লক্ষ্য ছিল ১৫ থেকে ১৬ লাখ করদাতা যোগাড় করা।’ প্রত্যাশার বেশি করদাতা যোগাড় হয়েছে বলে অনেকটাই উদ্যোমী হয়ে উঠেছেন অর্থমন্ত্রী।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১৬ কোটি মানুষের দেশে সরকারের ভাষ্যমতে ৩২ লাখ মানুষও যদি আয়কর দেয়, তাহলে তাও খুব সামান্য। নতুন করদাতা শনাক্ত ও তাদের কাছ থেকে আয়কর আদায়ের তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেই।

নতুন অর্থবছরে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি রাখা হচ্ছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এটি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও বাজেটে চার হাজার ৫১ কোটি টাকা বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার আশা করেছেন অর্থমন্ত্রী। ওই অনুদান পাওয়া গেলেও ঘাটতি থাকবে এক লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকার, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু সেই অনুদান কবে নাগাদ, কোথা থেকে আসবে বা পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে কোনও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। ফলে বাজেটের হিসাব মেলানো কঠিন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এনবিআর কখনোই সরকারের দেওয়া লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। এনবিআরের সেই জনবলও নেই, দক্ষতাও নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হচ্ছে এনবিআরের দক্ষতা বেড়েছে। এযাবৎকালে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশের বেশি বাড়েনি। সেখানে এ বছর প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩২ শতাংশ।’

তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সেই দক্ষতা নেই। এ বছরও সরকারের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন হবে না। কাজেই টাকার অঙ্কে বাজেট মিললেও প্রকৃতভাবে এ বাজেটের হিসাব মেলানো কতটা সম্ভব, তা অর্থমন্ত্রী নিজেই ভালো জানেন।’

বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘সংস্কার ছাড়াও যে এনবিআর ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে—এর জন্য অবশ্যই তারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। যদি এনবিআর রিফর্মগুলো করতো, আমরা এনবিআরের যে অটোমেশনের কথা শুনি; সেই অটোমেশন যদি হতো। ভ্যাটের কথা বলার পরও তা বাস্তবায়ন করতে পারা গেলো না। আমরা এখনও ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইন দিয়ে চলি। সেগুলো যদি পরিবর্তন না করা হয়, তাহলে আমাদের মধ্যে এ সন্দেহ থেকেই যাবে। এনবিআর টার্গেট অনুসারে রাজস্ব আদায় করতে পারবে কিনা? আর আমরা প্রশ্ন করতেই থাকবো—এ টার্গেট বাস্তবায়ন হবে কি হবে না।’

এ প্রসঙ্গে ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘ট্যাক্সনেট বাড়াতে না পারলে এ অর্জন এনবিআর করতে পারবে না। আর রাজস্ব আদায় করতে না পারলে বাজেটের অঙ্ক মেলানো সহজ হবে না। এক্ষেত্রে এনবিআর শর্টকাট পদ্ধতিতে রাজস্ব আদায়ের পথে চলে। যারা নিয়মিত ট্যাক্স দিচ্ছে এনবিআর তাদের পেছনেই ছুটছে। ভ্যাট পরিদর্শকরাও ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। ভ্যাটদাতাদের কাছে যান না।’

ট্যাক্সনেট বাড়লে রাজস্ব বাড়বে বলে বিশ্বাস করেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ট্যাক্সনেট বাড়াতে সহজ উপায় হচ্ছে নতুন করদাতা খুঁজে বের করতে উদ্যোগ নেওয়া। সব টিআইএনধারী অবশ্য ট্যাক্স দেয় না। তবে টিআইএনধারীর বাড়ি-বাড়ি যাওয়ার তো দরকার নেই। এনআইডি আছে, সেখানে সব ধরনের তথ্য আছে। তাই সেখান থেকেই তো টিআইএনধারী ট্যাক্স পে করার যোগ্য কিনা তা জানা যায়। গ্রামের একটি মুদি দোকানের মালিকও তা ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ৫ কোটি টাকা লোন নিচ্ছে। তাই জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামের পর্যায়ও ট্যাক্স দেওয়া লোকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তারা সেখানে যাচ্ছেন না।’

এ প্রসঙ্গে ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘গ্রাম পর্যায়ের করযোগ্য মানুষের কাছ পর্যন্ত ট্যাক্সের লোকজন যেতে পারবেন তখন, যখন সেখানে ট্যাক্সের অফিস থাকবে। কিন্তু আমাদের সে পর্যন্ত যাওয়া সম্ভব হয়নি। এখনও ট্যাক্সের অফিস সে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।’

ড. সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘রাজস্ব বিভাগের মোট কয়টি জোন অফিস রয়েছে, তা আমি জানি না। তবে, ঢাকা ও গাজীপুরে রাজস্ব বিভাগের ৫টি জোন অফিস রয়েছে। রাজস্ব বিভাগের যত অফিস ও লোকজন ঘোরাফেরা করে তা হলো ঢাকা, সাভার ও গাজীপুরে। তাই ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে এনবিআরের পক্ষে কতটুকু সাধ্য আছে বা এর দক্ষতা অর্জন করেছে সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’  

এদিকে, বাজেটে ঘাটতি মেটাতে অর্থমন্ত্রী বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন ৬০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ খরচ হবে। সরকারের নিট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০ হাজার ১৬ কোটি টাকা। ঘাটতির বাকি ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা নেওয়া হবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। এরমধ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে নেওয়া হবে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। বাকি তিন হাজার কোটি টাকা অন্যান্য উৎস থেকে। এগুলো ঠিকমতো নেওয়া যাবে কিনা বা যথাসময়ে পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব বাড়ানোর প্রত্যাশী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী পাঁচ বছরে আয়করদাতার সংখ্যা এক কোটিতে নিয়ে যাওয়ার আশা করছেন।

আরও খবর: যেভাবে জোগাড় ও ব্যয় হবে বাজেটের টাকা

 

 

/এসআই/এনআই/এএম/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হজ এজেন্সিগুলোর কথার সঙ্গে কাজের কোনও মিল নেই: ধর্মমন্ত্রী
হজ এজেন্সিগুলোর কথার সঙ্গে কাজের কোনও মিল নেই: ধর্মমন্ত্রী
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
টিভিতে আজকের খেলা (২ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২ মে, ২০২৪)
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!