X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘জোনিং’ কার্যক্রমে ধামাচাপা!

জাকিয়া আহমেদ
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৫৯আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১২:৫৯

দক্ষিণ ঢাকার প্রস্তাবিত রেড জোন দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর গত জুন মাসে জোনভিত্তিক লকডাউনের ঘোষণা দেয় সরকার। এরপর লকডাউন কার্যকর করতে প্রথমে গত ১৪ জুন এবং পরে ১৮ জুলাই গাইডলাইন তৈরি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সেই গাইডলাইনে আক্রান্ত রোগীর ভিত্তিতে লাল, হলুদ এবং সবুজ এলাকা নির্ধারণের নীতিমালার কথা বলা হয়। কিন্তু রাজধানী ঢাকার ভেতরে পাইলট ভিত্তিতে দুটি এলাকা এবং ঢাকা বিভাগের কয়েকটি জেলায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে লকডাউন কার্যকর করা হলেও বর্তমানে জোনিং সিস্টেম মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর একটি জোনিং সিস্টেম দেশে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতো। বিশেষ করে গত কোরবানির ঈদের পর রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় আবারও সেই জোনিং কার্যক্রম অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

দেশে করোনা পরিস্থিতি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যেকোনও সময় সংক্রমণ আবারও ব্যাপকহারে বাড়তে পারে। তাই এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কতটুকু প্রশ্ন করে তারা বলছেন—জোনিং সিস্টেমের একটা ধোয়া তুলে সময় নষ্ট করা হচ্ছে। কত ম্যাপ করা হলো, কিন্তু তার ভবিষ্যৎ আমরা এখন আর দেখতে পাচ্ছি না। সে কাজের অগ্রগতি কতটুকু সে বিষয়েও জানতে চান তারা। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে—লকডাউন কার্যকর হয়নি। বাঁচতে হবে মানুষের সচেতনতা দিয়ে।

প্রসঙ্গত, দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়, আর  প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয় গত ১৮ মার্চ। এরপর সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। দীর্ঘ ৬৬ দিনের এই ছুটিতে লকডাউন ব্যবস্থা না থাকায় সংক্রমণ বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এরপরই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে জোন ভাগ করে কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এ সংক্রান্ত কমিটিতে পদাধিকার বলে সভাপতি হলেন অধিদফতরের মহাপরিচালক। কিন্তু আগের মহাপরিচালক চলে যাবার পর গত ২০ জুলাইয়ের পর অধিদফতরে জোনিংয়ের বিষয়ে কোনও মিটিং হয়নি। জোনিং সিস্টেম বাস্তবায়ন কার্যক্রম ভাটা পড়ে গেছে, কার্যক্রমের কোনও অগ্রগতিও নেই। কারণ, হয়তো এর ওপরে আর জোর দেওয়া হচ্ছে না বলেও মন্তব্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের। তারা বলছেন, ঢাকার ভেতরে পূর্ব রাজাবাজার এবং ওয়ারীর অভিজ্ঞতা দিয়ে হয়তো চিন্তা করা হয়েছে, এটা খুব একটা কার্যকরী হবে না। একইসঙ্গে দেশের মানুষকে প্যানিক থেকে দূরে রাখতে পারলে অর্থনীতিতে গতি আনা যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, হয়তো পলিসি লেভেল অন্যভাবে চিন্তা করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জোনিং নিয়ে আসলে কিছুই হচ্ছে না। সব ধামাচাপা পড়ে আছে।

অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, হয়তো ওপরের মহলের ধারণা—দেশকে স্বাভাবিকের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাই এর (জোনিং) আর  দরকার নেই।

ঢাকার বাইরে গত ২১ জুন চট্টগ্রাম, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, যশোর, মাদারীপুর, ২২ জুন ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী ও কুষ্টিয়াতে, ২৩ জুন কক্সবাজার, মাগুরা, খুলনা, হবিগঞ্জ  জেলার কিছু কিছু এলাকাকে রেড জোন ঘোষণাসহ  সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

গত ১৮ জুলাই সবশেষ গাইডলাইন আপডেট করা হয় জানিয়ে অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথমে ছিল প্রতি লাখে ১০ জন আক্রান্ত হলে সে এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হবে। পরে সেটিকে আপডেট করে প্রতি লাখে ৩০ জন করা হয়। বিভিন্ন জেলার সিভিল সার্জনদেরও এই গাইডলাইন দেওয়া হয়। কিন্তু তারাও কোনও কারণে আটকে গেছেন। আবার রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা হিসাবে নির্ধারিত ছিল—এক লাখে ৬০ জন আক্রান্ত হলে তাকে রেড জোন ঘোষণা করা হবে। এক লাখ মানুষের মধ্যে পাঁচ থেকে ৫৯ জন আক্রান্ত হলে হলুদ এবং পাঁচ জনের নিচে হলে তাকে গ্রিন বা সবুজ হিসেবে ধরার জন্য গাইডলাইনে বলা হয়।

কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে প্রায় একশ’র বেশি  করতে হবে রেড জোন—মন্তব্য করে অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, জোনের সবাই অ্যাম্বুলেন্স চায়, খাবার চায়, ওষুধ, সাবান পর্যন্ত চায়। এতকিছু ম্যানেজ করে আসলে করা হয় না।

অধিদফতরের কর্মকর্তারা আরও বলছেন, ঢাকা শহরে জোনিং করা অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। শুরু থেকে এ বিষয়ে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘নেগেটিভিটি’ ছিল।

রেড জোন ‘দেশজুড়ে রোগী বাড়তে শুরু করেছে। তার ইফেক্টই হচ্ছে জোনিং সিস্টেম ধামাচাপা পড়ে থাকা’, মন্তব্য করে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইনফেকশন ছড়াচ্ছে দেশজুড়ে। আর লকডাউন ধামাচাপা পড়ার কারণ হচ্ছে—এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সরকারের সক্ষমতা নেই। সরকার লকডাউন করার সক্ষমতা রাখে না।’

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যে হারে দেশে রোগী বাড়ছে তাতে করে এখনও এটা (জোনিং) করা দরকার। কিন্তু সেক্ষেত্রে চায়নিজ বা ইতালিয়ান লকডাউনকে ফলো করলে হবে না। এখানে বাংলাদেশি লকডাউন করতে হবে। আর সেটা যদি করা হতো, তাহলে এখন  ধামাচাপা দেওয়ার দরকার হতো না। সেটা করার সক্ষমতা সরকারের ছিল।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কারও কথা শোনেনি। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেনি।’

একইসঙ্গে নজরুল ইসলাম  বলেন, ‘‘লকডাউন না করে ‘মপ আপ’ করতে হবে। মপ আপে কিছু বন্ধ করে রাখতে হবে না। কারও বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। পার্টিকুলার এরিয়াতে ধরে ধরে নমুনা নেওয়া হবে। যার নমুনা নেওয়া হবে তাকে নির্দিষ্ট জায়গাতে রাখতে হবে—ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত। ফলাফল যদি নেগেটিভ হয় তাহলে তিনি ফ্রি, তারতো মুভ করতে বাধা নেই। আর পজিটিভ হলে তাকে আইসোলেশনে নিতে হবে। বাকিদের কোয়ারেন্টিন করতে হবে, এতে করে কয়েকটি বাসা ইফেক্টেড হবে, পুরো এলাকা নয়।’’

‘কিন্তু পুরো এলাকা বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে সেভাবে লকডাউন রাজধানীতে সম্ভব নয়। এতে সময় এবং শ্রম নষ্ট হয়েছে। যারা সংক্রমিত তাদেরকে শনাক্ত করে আইসোলেটেড করতে হবে। পুরো এলাকা তালাবদ্ধ করা সম্ভব নয়। এটা চাইনিজ-ইতালিয়ান সিস্টেম—এটা বাংলাদেশ অচল’, বলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।

লকডাউন কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে কেন প্রশ্নে স্বাস্থ্য সচিব আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লকডাউন যেহেতু কার্যকরভাবে করা যাচ্ছে না…। এখন যেভাবে আছে সেভাবেই চলবে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।’ মানুষের সচেতনতার অজুহাত দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায় কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মানুষের সচেতনতা দিয়েই আমরা বেঁচে আছি। আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো—মানুষ কেন মাস্ক পরে না—আমরা মোবাইল কোর্ট করছি, কত কিছু করছি, অ্যাকশনও তো নিচ্ছি।’

মানুষ যদি নিজের সচেতনতা না বোঝে, নিজে বাঁচতে না চায়, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কতটুকু করতে পারে বলে প্রশ্ন রাখেন স্বাস্থ্য সচিব। তিনি বলেন, ‘এটা হচ্ছে কল্যাণ রাষ্ট্র। কল্যাণ রাষ্ট্রে মানুষকে কতটা আইন ইম্পোজ করতে পারি, সেটাও দেখতে হবে।’

মানুষ আইন মানছে না বলেই আইন প্রয়োগ করতে হবে মন্তব্যে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রে মানুষ আইন মানছে।’ সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিচ্ছে জানালে তিনি বলেন, ‘আমরাও নিচ্ছি। যারা মাস্ক পরছে না তাদের ফাইন করা হচ্ছে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা ফাইন হচ্ছে শুধু মাস্ক  না পরার কারণে।’ আমরা এর চেয়ে বেশি আর কতটা করতে পারবো মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সচেতনতাই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে মনে করি।’

তাহলে লকডাউনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল কিনা প্রশ্নে স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান বলেন, ‘সিদ্ধান্ত ভুল ছিল সেটা আমরা বলবো না। এটা যথাযথভাবে কার্যকর করা আমাদের দেশে…সিটি করপোরেশন চেষ্টা করেছে। সবাই ট্রাই করেছে। কিন্তু ঢাকা সবচেয়ে জনবহুল রাজধানী। আমরা কতটা করতে পারবো, কতটা করতে পারি…।  তাই মানুষের সচেতনতাই আমাদের উদ্ধার করবে, মুক্তি দেবে।’

লকডাউন কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সুস্পষ্ট ভাবনা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেশব্যাপী স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার জন্য নানান চিন্তাভাবনা করছি। আর কী করা যেতে পারে মানুষকে সচেতন করতে—সেগুলো নিয়ে ভাবছি।’ দেশে ১২ -১৩ কোটি মানুষের হাতে ফোন রয়েছে, তারা  উপদেশমূলক কথা শুনতে পাচ্ছে এগুলো কী কাজ হচ্ছে না—কাজ হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

‘দেশ স্বাভাবিকতা চায়, কিন্তু সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, নয়তো স্বাভাবিক হবে কীভাবে’, প্রশ্ন রেখে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেখানে যেটা প্রযোজ্য…কোনও কোনও সময়ে পুরো দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ করা দরকার হতে পারে, কোনও সময়ে কোনও জেলা বা উপজেলা, কয়েকটা বাড়ি—সেটা জনস্বার্থ বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ ঝুঁকি বিবেচনা করে করবে, কিন্তু একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’

‘ঢাকার ভেতরে পূর্ব রাজাবাজার এবং ওয়ারী লকডাউন হওয়ার পর আর কিছুই এগোয়নি। তৎপরতাও নেই। এভাবে চলবে না, বরং সবকিছু গুছিয়ে এটাকে ভালোভাবে সেন্ট্রালি কোঅর্ডিনেট করতে হবে’, বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।

/এপিএইচ/এফএএন/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী