বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করে দেওয়ার নীলনকশা কার্যকরের সময় চোখের সামনে থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে যে মা-বাবাদের হত্যা করা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলায় সেই বাবা-মায়ের সন্তানদের বেড়ে ওঠার লড়াই এখনও অব্যাহত। স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ হয়নি তাদের জীবনে। অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন দেশের যে স্বপ্ন দেখে শহীদ হয়েছিলেন তারা, তাদের সেই স্বপ্নপূরণে কতটা সমর্থ হয়েছে বাংলাদেশ? শহীদসন্তানেরা বলছেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনের আগে দিয়ে আমাদের নিজেদের পেছন ফিরে মূল্যায়নের সময় এসেছে। সেই মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যদি সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে আগামী কুড়ি বছরের পরিকল্পনা করা যায় তাহলে হয়তো পিছিয়ে পড়া জায়গাগুলোতে আমরা এগিয়ে যাবো। আশাহত না হলেও বারবার ধর্মনিরপেক্ষতার ইস্যুতে পিছিয়ে পড়াটাকে হোঁচটের জায়গা উল্লেখ করে তারা এও বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কথা লিখলে, তা যদি ধর্ম বা নারী সম্পর্কে হয়, তাহলে যে মন্তব্যগুলো আসে, তা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা এখনও কতটা হিংস্র জীবন-যাপন করছি।
রাজনীতি এবং সংস্কৃতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলবে, এটাই ছিল আশা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ হয়ে ওঠার পথে পিছিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘসময় ক্ষমতায় আসীন হয়ে দেশকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে দেয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা এ দেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছিল, তার নজির ইতিহাসে খুব বেশি নেই। ভয়াল নয় মাসের সব নৃশংসতা ছাপিয়ে গিয়েছিল তালিকা করে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার ঘটনায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা রাতের অন্ধকারে লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-চিকিৎসক-সাংবাদিক-প্রকৌশলীদের ধরে হত্যা করে। তাদের সন্তানেরা লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন গত ৪৯ বছরে। শৈশব-কৈশোরে বাবা হারানোর মধ্য দিয়ে পাওয়া স্বাধীন দেশকে কেমন দেখতে চেয়েছিলেন আর অভিজ্ঞতায় কেমন পেলেন তারা?
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সন্তান জাহীদ রেজা নূর শুরু করলেন অসাম্প্রদায়িকতার জায়গা থেকেই। তিনি বলেন, রাষ্ট্রে মানুষ পরিচিত হবে মানুষ হিসেবেই, তার ধর্ম পরিচয়ে নয়। প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানুষের মূল্যায়ন হবে তার কাজের ভিত্তিতে, তেলবাজি বা পেশিশক্তির ভিত্তিতে নয়। ঘুষ, দুর্নীতি, ধর্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে জিরো টলারেন্স। পরিবার ও শিক্ষালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে দেশপ্রেম থাকতে হবে ষোলআনা এবং তা ছড়িয়ে দিতে হবে সকল শিশুর মনের ভেতর। কোনোভাবেই কোনও ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া চলবে না। রাষ্ট্রের হবে অসাম্প্রদায়িক চেহারা।
তিনি বলেন, ফেসবুকে কোনও একটি কথা লিখলে, তা যদি ধর্ম বা নারী সম্পর্কে হয়, তাহলে যে মন্তব্যগুলো আসে, তা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমরা কতটা হিংস্র জীবন-যাপন করছি। রাজনীতি এবং সংস্কৃতি পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলবে, এটাই ছিল আশা। নারীর জীবনের সিদ্ধান্ত নারীই নেবে, কোনও পুরুষ নয়, এটাই ছিল চাওয়া। প্রগতিশীল বা সুশীল ভেক ধরে আপ্তবাক্য না ছেড়ে সত্যিকার অর্থেই মানুষের কল্যাণের কথা ভাবা। রাজনীতি ও দুর্নীতি যেন সমার্থক শব্দ না হয়ে যায়, বরং রাজনীতির অর্থ দেশ ও দশের সেবা হয়, সেটাই ছিল আরাধ্য। আমার এ কথাগুলো থেকে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে, কেমন বাংলাদেশ চেয়েছি।
সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি লেখা রয়েছে, সেই বাংলাদেশের জন্য বাবারা আত্মাহুতি দিয়েছেন বলেই জেনে এসেছি, শিখে এসেছি আর বিশ্বাস করি এবং সেই বাংলাদেশই দেখতে চেয়েছিলাম আমি, বলেন শহীদ চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, আমি খুব অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, সাম্য এবং সুবিচারিক একটা বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম।
সেই মূলনীতির পাল্লায় যদি বর্তমান বাংলাদেশকে মাপতে যাই, তাহলে অনেক পিছিয়ে আছি। আর সেই পিছিয়ে যাবার কারণ যেমন আমি অনুধাবন করি, আবার এটাও ঠিক জাতির পিতাকেই হত্যা করা হয়েছে এই দেশে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অভাব ছিল, জাতীয় চার নেতার অভাব ছিল। সেই সঙ্গে ছিল দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতাবিরোধীরা দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় অবশ্যই বড় একটা প্রভাব রয়েছে, যা থেকে আজও মুক্ত হতে পারিনি, পুরো বিষয়টিকে ঠিক করতে পারিনি।
‘সামনে যুদ্ধের একটা মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি বটে, তবে আমি আশাবাদী।’ এমন মন্তব্য করে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, যখন তরুণ প্রজন্মের দিকে তাকাই, পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান যখন বসতে দেখি, করোনাকালে প্রবৃদ্ধি যখন দেখি, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা যতক্ষণ আমাদের নৌকার হাল ধরে আছেন, আমি ততক্ষণ আশাবাদী। তবে আশাবাদী হলেও এখন মনে হচ্ছে আরেকটু আমাদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষকে উৎপাটন করবো।
নুজহাতের কথার রেশ ধরেই তরুণ প্রজন্মের দেশপ্রেমকে জিইয়ে রাখতে সঠিক দিকনির্দেশনা দরকার উল্লেখ করে শহীদ মুনির চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর বলেন, আমাদের বাঙালি পরিচয়ের জায়গায় তরুণ সম্প্রদায় থেকে সাম্প্রতিক সময়ে ভালো কিছু উদ্যোগ দেখেছি। তরুণরা দেশকে নিয়ে ভাবে। কিন্তু তাদের গাইড করার জায়গায় বড়রা যারা আছেন তারা একটা পর্যায়ে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যান। কিন্তু আশার কথা হলো, তরুণরা ভাবতে জানে, ভাবে। কিন্তু ভাবপ্রকাশের জায়গায় তাদের ছোট করে দেখা হয়। সেই জায়গাটা খুলে দেওয়া দরকার। না হলে সামনে তারা হয় দেশপ্রেম হারিয়ে ফেলবে, বা অভিমানে দেশপ্রেম প্রকাশ করবে না।
৪৯ বছর পার করে যখন কিনা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন নিজেদের অবস্থানকে মূল্যায়ন করতে পারা জরুরি। প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী কিংবা সাধারণ জনগণ, সবারই মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করা উচিত এটা খুঁজে দেখতে যে এতোগুলো বছরে কোন কোন জায়গায় অর্জন এলো।
বাংলাদেশ বারবারই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে গিয়ে হোঁচট খায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আমরা ’৭২-এর সংবিধানে ফিরতে চেয়েও পুরোপুরি ফিরতে পারছি না। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ইসলামী সংগঠনের প্রতি প্রশ্রয়, শহীদদের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সরকারের আন্তরিকতা নেই বলবো না, চেষ্টার মধ্যে ও প্রয়োগের মধ্যে ফারাক থেকে যাচ্ছে।
জাতীয় জীবনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে এই শহীদ সন্তান বলেন, সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন মাঝে মাঝেই মুখ থুবড়ে পড়ে। জাতীয় পরিচয় প্রকাশে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে ভূমিকা সেটাতে ঝিমিয়ে পড়া ভাব। সব মিলিয়ে এখন কেবল অর্থনৈতিক মুক্তি নয়, সামাজিক সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য পরিকল্পনা করতে হবে।