‘কারি’ শব্দটার ব্যুৎপত্তি নিয়ে ক’দিন আগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ শেফ ও ফুড ব্লগার চাহেতি বানশাল বেশ একচোট ঘোল পাকিয়েছিলেন। তাতে আলোচিত-সমালোচিত দুটোই হয়েছিলেন তিনি। তবে এবার ‘অবুঝ’ মন্তব্য করে ধরাশায়ী হলেন আমেরিকার রম্যলেখক জিন ওয়েইনগারটেন। ভারতীয় খাবারের প্রতি অনীহার কথা জানাতে গিয়ে একপর্যায়ে উগরে দিলেন মহাআপত্তিকর একখানা মন্তব্য— ভারতের যাবতীয় খাবার নাকি এক মসলায় রান্না করা। এমনকি এমন একটি বাক্য নির্দ্বিধায় ছেপে ফেললো ওয়াশিংটন পোস্টের মতো নামজাদা পত্রিকাও!
গত ১৯ আগস্ট মন্তব্য প্রতিবেদন বিভাগে ওয়েইনগারটেন লিখেছেন, ‘ভারতীয় উপমহাদেশ আমাদের কত কিছুই না দিয়েছে- দাবা, জামার বোতাম, শূন্যের ধারণা, চোখের ছানির অপারেশন, শ্যাম্পু, ইউএসবি পোর্ট...এবং এমন এক জাতিগত খাবার যা কিনা মাত্র একটি মসলা দিয়েই রান্না করা।’
যদিও লেখক মশাই ভারতীয় খাবারের গোত্র উদ্ধার করেছেন আরও এক পরিচ্ছেদজুড়ে, তথাপি, ভারতসহ উপমহাদেশের বাসিন্দাদের অন্তরে মরিচ ছিটিয়ে দিতে ওই একটি বাক্যই যথেষ্ট।
টুইটারে ওয়েইনগারটেনকে প্রথম দফায় পেঁয়াজ-ছেলা করেছেন আমেরিকান-ভারতীয় তারকা শেফ ও টপ শেফ কুকিং প্রতিযোগিতার হোস্ট পদ্ম লক্ষ্মী। তিনি ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘এই ২০২১ সালে (অথবা কখনোই) এসে এমন একটা লেখা প্রকাশের কোনও দরকারই ছিল না। এটা বর্ণবাদী ও একেবারেই মনগড়া। ওই লোক (ওয়েইনগারটেন) কী খেয়েছে ও কেন তার সেটা ভালো লাগেনি সেটা আমার ইস্যু না। আমার সমস্যা হলো, তিনি একটা রম্য রচনা লিখতে গিয়ে পুরনো ধাঁচের ঔপনিবেশিক বক্রোক্তিই করেছেন। খুব দুর্বল একটি খোঁচা ছাড়তে গিয়ে তিনি আসলে ১৩০ কোটি দেশের একটি সংস্কৃতিকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করেছেন।’
পদ্ম লক্ষ্মীর পরপরই বাকিরা নড়েচড়ে বসে। যারা আগে পড়েননি তারাও কলামে চোখ বুলিয়ে জবাব দিতে থাকেন। পদ্ম লক্ষ্মীর পোস্ট পড়ে ওয়েইনগারটেনও বুঝে ফেললেন ঘটনা কোন দিকে গড়াচ্ছে। দ্রুত মাফ চেয়ে টুইট করলেন। বললেন, ‘মসলার ব্লেন্ড আর মসলাকে এক করে ফেলেছিলেন তিনি (যদিও তাতে কিছু পরিষ্কার হয় না)। কলামটা ছিল আগাগোড়া বোকামিতে ঠাসা।’
নিজেকে আচ্ছামতো গালমন্দ করেও অবশ্য নেটিজেনের হাত থেকে নিস্তার পাননি। ভারতীয় খাবারে ‘একটি মাত্র মসলা’র ব্যবহার নিয়েই দেখা গেলো সবাই বেশ সরব। কেউ বললেন, ‘ওই বোকার হদ্দ কি জানে যে আমি আমার অমলেটেই আট পদের মসলা দেই?’ আবার কেউ একগাদা মসলার ছবি দিয়ে বললেন, ‘ওয়েইনগারটেন সাহেব ঠিক কোন মসলাটার কথা বলেছেন?’ খেপেছেন খোদ আমেরিকানরাও। অনেকেই ওয়েইনগারটেনের কলাম নিয়ে বেশ লজ্জিত বলে টুইট করেছেন।
পরিশেষে ‘ঝাল’ কমাতে কারিতে ‘আলু’ কেটে দিলো ওয়াশিংটন পোস্ট। ছাপলো সংশোধনী। তাতে বলা হলো, ‘আগের নিবন্ধে ভুল করে বলা হয়েছে ভারতীয় রন্ধনশৈলী একটি মসলার ওপর নির্ভরশীল, ওটা মূলত এক ধরনের ঝোলকে বোঝানো হয়েছিল। বস্তুত, ভারতের বৈচিত্র্যভরা রন্ধনশৈলীতে বহু ধরনের মসলার ব্যবহার আছে এবং এতে অনেক ধরনের খাবার তৈরি করা যায়। নিবন্ধটি সংশোধন করা হলো।’
প্রশ্ন হলো, উপমহাদেশের খাবার যে বৈচিত্র্যে ভরা ও এ অঞ্চলে যে অনেক মসলার ব্যবহার আছে, সেটা কি ওয়াশিংটন পোস্ট এ মাসে নতুন করে জানলো? ক’দিন আগেই কিন্তু মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম হয়েছেন জাস্টিন নারায়ণ ও তৃতীয় কিশোয়ারা। দুজনই এ উপমহাদেশের বংশোদ্ভূত। দুজনই তাদের ভারতীয় রন্ধনশৈলী দিয়ে জয় করে এসেছেন বিচারকদের ঘ্রাণেন্দ্রিয়।
আবার এক পরত ইতিহাস পড়লেও তো হতো। সবাই তো জানে যে ভারতবর্ষে প্রথম যুদ্ধ হয় মসলার জন্যই। পর্তুগিজদের সঙ্গে কালিকটের রাজার মধ্যে হয়েছিল যুদ্ধটা। আর এই মসলার খোঁজেই ভাস্কো দা গামা এসেছিলেন কেরালা উপকূলে।