X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

গুমকারীরা প্রশিক্ষিত, রাষ্ট্র নীরব

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২৩ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:০৯আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৮

‘গুম’ শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি বর্তমানে প্রতি পাঁচ দিনে একজন গুম হচ্ছেন। তাদের কেউ ফিরছেন, কেউ ফিরছেন না। যারা ফিরছেন, তারা কোনও কথাও বলছেন না। গুমের এসব ঘটনার কোনও কিনারা না হলেও একটা বিষয় স্পষ্ট, যারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা অনেক বেশি স্মার্ট, অনেক বেশি প্রশিক্ষিত। গুমের জন্যই যেন প্রশিক্ষিত ও স্মার্ট একটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এ প্রশ্নও উঠছে, এই গ্রুপ কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী? এ পরিস্থিতিতে সমাজে গুম নিয়ে একটি ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই গুমকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আর এ বিষয়ে রাষ্ট্রও নীরব। তাতে গুমের নৃশংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) বিকাল সাড়ে ৪টায় রজধানীর শুক্রাবাদে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত ‘গুম’ শীর্ষক বৈঠকিতে বক্তারা এসব কথা বলেন।
মুন্নী সাহা মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় বৈঠকিতে অংশ নেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি) এনামুল হক, মানবাধিকারকর্মী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নূর খান, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, রাজনৈতিককর্মী ফিরোজ আহমেদ, বেসরকারি টিভি চ্যানেল ডিবিসি’র সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু ও বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ।
বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ বৈঠকিতে বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ বলেন, ‘যারা গুম করে তারা খুবই প্রশিক্ষিত, খুবই স্মার্ট। গুমের জন্য একটি প্রশিক্ষিত স্মার্ট গ্রুপ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো— সেই স্মার্ট গ্রুপ কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চেয়েও শক্তিশালী? নাকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ভয় পায়? না হলে এইসব গুমের কূল-কিনারা হয় না কেন?’
তিনি আরও বলেন, ‘হঠাৎ করেই দেশে গুমের একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, গুমের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু কী এমন ঘটলো যে গুমের প্রয়োজন পড়লো। আবার গুমের কারণ বলতে পারার পেছনেও একটাও গুমের ভয় থেকে যায়। গুম হয়ে অনেকে ফিরে এসেছেন। তারা কেউ কেউ কথাও বলেছেন। যেমন, জোহাকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তিনি অনেক পরে কথা বলেছেন, আর যা বলেছেন তা খুবই শর্টকাট।’
জায়েদুল আহসান পিন্টু বেসরকারি টিভি চ্যানেল ডিবিসি’র সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘যারা রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণকারী, কোনোভাবে মতাদর্শের সঙ্গে মিলছে না, এমন লোকই গুম হয়। আর যারা গুম করছে তারা অনেক স্মার্ট ও ক্ষমতাধরও বটে। তা না হলে এত সুন্দর করে কৌশলে গুম করা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘গুমের ঘটনাগুলোর তদন্তের একটা পর্যায়ে দেখা যায়, তদন্তের আর কোনও অগ্রগতি হয় না। একটা পর্যায়ে গিয়ে পুলিশ আর কিছু বলতে চায় না। দায়সারা কথা বলে। বলে তদন্ত চলছে। কিন্তু ওই তদন্তের আর কোনও কূল-কিনারা আলোর মুখ দেখে না। তারা সরাসরি বলে, তারা কিছু জানে না। কিন্ত গুম বিষয়টিতে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। পুলিশ পারে না— তা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।’
জায়েদুল আহসান পিন্টু আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রের দর্শন যদি থাকে, রাজনৈতিক ইচ্ছে থাকে, তাহলে একজন মানুষও আর নিখোঁজ হবে না। কিন্তু রাষ্ট্র সেই অবস্থানটি নিচ্ছে না। এই জায়গা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণকারীরাই গুম হয়। এখন যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, গুমেরও একসময় সামাজিক বৈধতা তৈরি হবে। সমাজ এসব ঘটনাকেও সহজেই গ্রহণ করে নেবে।’
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি এনামুল হক বিচারহীনতার কারণেই গুমের সঙ্গে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে বলে বৈঠকিতে মন্তব্য করেন পুলিশের সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি) এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘বিচারহীনতা মানেই দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতার অভাব। এটা সত্যি, বাতাসে ভয়ের আবহওয়া তৈরি হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক।’
গুম হওয়ার ঘটনায় প্রশাসন বা পুলিশের দায় নিয়ে সাবেক আইজি বলেন, ‘পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে কাজ করে, সেটাই তাদের করার কথা। কিন্তু তারা প্রজাতন্ত্রের হয়ে কাজ করছে নাকি অন্য কারও হয়ে কাজ করছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির তফাৎ থাকতে পারে। গুম হওয়াদের মধ্যে তিনটি দল তৈরি হয়েছে— কেউ ফিরছে, কেউ ফিরছে না, বাকিরা ফিরলেও কথা বলছে না। এখন ফিরে আসা কেউ কেউ কথা বলতে শুরু করেছেন। অনিরুদ্ধ নামের নিখোঁজ এক ব্যবসায়ী ফিরে আসার তিন দিনের মাথায় লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ, এর মাধ্যমে কথা বলে আলোচনার পথ দেখিয়েছেন তিনি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে আলোচনা করবেন কিনা, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। একসময় তো প্রতিবাদ হতো না, এখন প্রতিবাদ হয়। তিনি ফিরে এসে কথা বলে প্রতিবাদেরও সুযোগ করে দিয়েছেন।’
বৈঠকিতে সাবেক আইজি আরও বলেন, ‘ভয়ের আবহাওয়া থেকে রেহাই পেতে প্রতিবাদ করতে হবে। তা না করতে পারলে আমাদের যতটুকু সাহস ছিল, তাও হারিয়ে যাবে। এসব নিয়ে সংসদেও আলোচনা হচ্ছে না। নীতিনির্ধারকরা এই পরিস্থিতি থেকে রেহাই দিতে এগিয়ে না এলে তারাও কিন্তু তাদের অনুসারীদের কাছ থেকে নিজেদের চাওয়া অনুযায়ী আচরণ পাবেন না। ফলে গুম হয়ে যাওয়ার এই পরিবেশ দূর করতে না পারলে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে।’
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘যদি এই গুমের পেছনে রাষ্ট্রীয় মদত থাকে বা রাজনৈতিক কোনও স্বার্থ থাকে কিংবা রাষ্ট্র যদি এক্ষেত্রে কোনও উদাসীনতা দেখিয়ে থাকে, তাহলে এই গুমের নৃশংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। গুম একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং এই অপরাধকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবেও আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘গুম শব্দটি ব্যবহার করলে এই অপরাধের ভয়াবহতা স্পষ্ট হয় না। কিন্তু ইংরেজিতে এর অর্থ স্পষ্ট। ইংরেজিতে শব্দটি ‘ফোর্সড ডিজঅ্যাপেয়ারেন্স’। এর অর্থ এভাবে বোঝানো হয়েছে- জোরপূর্বক বা বলপূর্বক একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তুলে নিয়ে নিখোঁজ করে দেওয়া। এর ভয়াবহতার মাত্রা এ কারণে বেশি যে এর শিকার ব্যক্তিকে আইনের স্পর্শ থেকে দূরে রাখা হয়। তিনি চাইলেই তার নিজের বিচার চাইতে পারেন না। তিনি সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েন।’
মিজানুর রহমান আরও বলেন, ‘আমরা এতকিছু জানার পরও এই ধরনের অপরাধ দেশে কেন হচ্ছে? এসব অপরাধ তখনই ঘটে, যখন সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। যখন স্বচ্ছতার মাত্রা অনেক কম হয়, তখন অতি উৎসাহীরা সুযোগ পেয়ে যায়। চেইন অব কমান্ড না থাকলে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনেকেও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। আর এসব কারণেই সমাজে গুমের মতো একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভয়ের সংস্কৃতিও তৈরি হয়েছে।’
রাজনৈতিককর্মী ফিরোজ আহমেদ রাজনৈতিককর্মী ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘সবাই জানছে, কারা গুমের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু রাষ্ট্র এর প্রতিরোধে কী করছে? রাষ্ট্রের কাজ কী? তারা কেন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না? দেশে যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে, তখন এই ধ্বংসলীলা থেকে কে রেহাই দেবে? সেই দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্রই নীরব। ফলে আমরা যত আলোচনাই করি না কেন, এতে কোনও কাজ হবে না। রাষ্ট্রের কাজ রাষ্ট্র না করলে কোনও লাভ হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই জানি, গুম নিয়ে পত্রিকায় যতটুকু খবর আসে, পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। এখানে আমরা আজ আলোচনা করছি। তবে কেউ কিন্তু কোনও গ্রুপের নাম বলতে পারিনি। এখানেও একটি সেন্সরশিপ কাজ করছে।’
মানবাধিকারকর্মী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নূর খান মানবাধিকারকর্মী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নূর খান মনে করছেন, গুম নিয়ে আলোচনা হলেও সেখানে স্পষ্ট করে সবকিছু বলার পরিবেশ নেই। তিনি বলেন, ‘আজকের এই আলোচনার বিষয় গুম। আমরা সবকিছু বুঝেও স্পষ্ট করে এ বিষয়ে অনেক কথা বলতে পারছি না। এটাই বাস্তবতা। এর পেছনে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা। কাউকে অপহরণ করার পর রাজনৈতিককর্মীরাও যদি এর প্রতিবাদ করেন, তারাও ভয়ে থাকেন যে কখন তারা গুম হয়ে যান।’
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘যারা ফিরে এসেছে, তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছি। একবার যেহেতু গুম হয়েছে, আবারও গুম হওয়ার আশঙ্কা কাজ করে তাদের মধ্যে। এ কারণেই গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে কথা বলে না। এই যে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এই সংস্কৃতি থাকলে প্রতিবাদ করবেন কিভাবে? প্রশ্ন থেকে যায়, সমাজে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করার জন্যই এগুলো করা হচ্ছে কিনা।’
রাজধানীর শুক্রাবাদে বাংলা ট্রিবিউন স্টুডিও থেকে বৈঠকিটি সরাসরি সম্প্রচার করে এটিএন নিউজ। পাশাপাশি বাংলা ট্রিবিউনের ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটেও লাইভ দেখানো হয় বৈঠকি।
আরও পড়ুন-
‘গুম’ শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি শুরু

‘রাজনৈতিকভাবে দ্বিমত পোষণকারী লোকই গুম হয়

যারা গুম করে তারা খুবই প্রশিক্ষিত: হারুন উর রশীদ

‘গুমের প্রতিবাদকারীরাও ভয়ে থাকেন, কখন গুম হয়ে যান’

‘রাষ্ট্র উদাসীনতা দেখালে গুমের নৃশংসতা আরও ভয়াবহ রূপ নেয়’

বিচারহীনতার কারণেই গুমকারীরা পার পেয়ে যাচ্ছে: সাবেক আইজিপি

গুম থেকে রেহাই দেওয়ার দায়িত্ব যার, সেই রাষ্ট্রই নিরব: ফিরোজ আহমেদ

/আরএআর/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সম্পূর্ণ দুর্ভিক্ষের কবলে উত্তর গাজা: ডব্লিউএফপি প্রধান
সম্পূর্ণ দুর্ভিক্ষের কবলে উত্তর গাজা: ডব্লিউএফপি প্রধান
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীর মুখেই কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীর মুখেই কুলুপ
চিনি-লবণ মিশিয়ে নকল প্যাকেটে স্যালাইন তৈরি, গ্রেফতার ৩
চিনি-লবণ মিশিয়ে নকল প্যাকেটে স্যালাইন তৈরি, গ্রেফতার ৩
জিকোর কপালে গভীর ক্ষত, সার্জারির পর হাসপাতালে ভর্তি 
জিকোর কপালে গভীর ক্ষত, সার্জারির পর হাসপাতালে ভর্তি 
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে