X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াবা আসছেই, পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলো বহাল তবিয়তে

জামাল উদ্দিন ও আবদুল আজিজ
১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১২:২০আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:৪৬

ইয়াবা মিয়ানমার ও ভারতের বিভিন্ন স্থান দিয়ে ইয়াবা দেশে ঢুকলেও ইয়াবার প্রধান উৎস মিয়ানমার। নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে ইয়াবা। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) বেশিরভাগ সদস্য সরাসরি জড়িত ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে। তাদের সহায়তা করত রাখাইনের বাসিন্দা কিছু রোহিঙ্গা। গত বছরের আগস্টে মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক এখনও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। শুধু তাই নয়, সীমানার দু’পারের ইয়াবা পাচারকারী সিন্ডিকেটগুলোও আছে বহাল তবিয়তে। তাই কমেনি ইয়াবা পাচার। বরং রোহিঙ্গা সংকটের সুযোগ নিয়ে এর পাচার কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেড়েছে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার আগে ও পরে ইয়াবা পাচারের চালচিত্র পাওয়া যাবে বিভিন্ন বাহিনীর ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা ও তাদের বক্তব্য থেকেই।

কক্সবাজারের টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, মানব পাচারকারী ও ইয়াবা পাচারকারীরা একই চক্র। যারা সমুদ্রপথে মানব পাচার করে, তাদের বেশিরভাগই ইয়াবা পাচারে জড়িত। আবার আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা নাগরিকদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের পর প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে বিভিন্ন সময় আসা তিন লাখ রোহিঙ্গাসহ প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। এর বাইরেও আরও তিন থেকে চার লাখ রোহিঙ্গা রাখাইনে অবস্থান করছে। তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।

দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর সহযোগিতায় রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করে আসছে বলে মনে করেন টেকনাফের বাসিন্দা আবদুল মোতালেব। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা সোলায়মানেরও একই অভিমত। তারা বলেন, জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার নামে ইয়াবাসহ কোটি কোটি টাকার মাদক পাচার করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

এর মধ্যে সমুদ্রপথে পাচারের সময় গত দুই সপ্তাহে বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্টগার্ড ৬৫ কোটি টাকা মূল্যের ইয়াবা উদ্ধার করেছে। গত ৫ জানুয়ারি বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার চ্যানেল থেকে ৫ লাখ পিস ইয়াবাসহ আট জনকে আটক করে র‌্যাব-৭। উদ্ধার করা ইয়াবার  আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এর পরদিন ৬ জানুয়ারি টেকনাফে সাড়ে ২২ কোটি টাকা মূল্যের আরেকটি ইয়াবার চালান জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ওইদিন সকালে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের কাটাবুনিয়া সাগরপাড় এলাকা থেকে এসব ইয়াবা জব্দ করা হয়।

এর এক সপ্তাহ পর, ১৩ জানুয়ারি টেকনাফের সেন্টমার্টিনের অদূরে কোস্টগার্ডের ধাওয়ার মুখে চোরাকারবারীদের ফেলে যাওয়া একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে চার লাখ ২০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। কোস্টগার্ডের কর্মকর্তাদের দাবি, এর মূল্য ২১ কোটি টাকা। এর পরদিন টেকনাফ উপজেলার শাহপরীরদ্বীপ থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ইয়াবা জব্দ করে বিজিবি। গতকাল সোমবারও (১৫ জানুয়ারি) টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের জাহাজপুরা এলাকার থেকে ৩৬ লাখ টাকার মূল্যের ইয়াবাসহ একটি ইজিবাইক আটক করছে বিজিবি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মাফিয়া চোরাচালানিদের বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার থেকে আসা মাদকের চালান সমুদ্র পথে উপকূলীয় এলাকা হয়ে দেশে ঢুকছে। সমুদ্রপথে এগুলো টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, সাবরাং, উখিয়া উপজেলার মনখালী, মহেশখালীর সোনাদিয়া, ঘটিভাঙ্গাসহ পেকুয়া উপজেলার মগনামা ও উজানটিয়া, কুতুবদিয়া ও আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্রপথে খালাস হয়। বিশেষ করে টেকনাফ উপকূল দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঢুকছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাঈদ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানব পাচারকারী ও ইয়াবা পাচারকারীরা একই সূত্রে গাঁথা।’ কোস্টগার্ড টেকনাফের স্টেশন কমান্ডার জাফর ইমাম সজিব বলেন, ‘সাগরপথে ইয়াবা পাচার নতুন কিছু নয়, এটি দিনের পর দিন চলে আসছে।’

র‌্যাব-৭ কক্সবাজার কার্যালয়ের কোম্পানি কমান্ডার মেজর রুহুল আমিন বলেন, ‘শুধু সাগরপথে নয়, স্থলপথেও যাচ্ছে ইয়াবা। সম্প্রতি সাগরপথকে নিরাপদ রুট হিসাবে বেছে নিয়েছে পাচারকারীরা। সে বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছে র‌্যাব সদস্যরা। মানব পাচারকারীদের বেশিরভাগ সদস্য ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে বলে জানান তিনি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিদিন কোনও না কোনও এলাকা থেকে ইয়াবা, গাঁজা, মদ, হেরোইন ও ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হচ্ছে এবং মাদকের সাথে জড়িতের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।’

বিজিবি’র ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম অবশ্য মানবপাচারকারীদের ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন। তিবি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত বছর থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গণকবর আবিষ্কার হওয়ার আগ থেকেই তারা এ কাজে জড়িত। তারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সাগর উপকূল দিয়ে মানবপাচার করত। তখন থেকেই মিয়ানমার ফেরত ট্রলারগুলো ইয়াবা নিয়ে দেশে ফিরত।’

২০১৭ সালের ইয়াবা উদ্ধারের চালচিত্র

র‌্যাব থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, র‌্যাব ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে ইয়াবা উদ্ধার করেছে ৮৬ হাজার ৯৮৬ পিস। ফেব্রুয়ারি মাসে এর পরিমাণ ছিল পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ২২১ পিস। এছাড়া, মার্চে সাত লাখ ৯৭ হাজার ৮৫২ পিস, এপ্রিল মাসে ২১ লাখ ৩৮ হাজার ৩৪৪ পিস, মে মাসে এক লাখ দুই হাজার ৯৬৫ পিস, জুন মাসে ১৫ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪ পিস, জুলাই মাসে এক লাখ ৬১ হাজার ৪২২ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়।

আগস্ট মাসে উদ্ধার হওয়া ইয়াবার সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৪৩ হাজার ৩১৮ পিস, সেপ্টেম্বর মাসে আট লাখ ৭৬ হাজার ৬২৫ পিস, অক্টোবর মাসে চার লাখ ৩০ হাজার ৭৬৮ পিস, নভেম্বর মাসে চার লাখ ৫৮ হাজার ৯৪৯ পিস ও ডিসেম্বর মাসে দুই লাখ ২৩ হাজার ৬১ পিস। এসব ইয়াবার বেশিরভাগই ঢাকা ও চট্টগ্রাম এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ সদর দফতর থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ৪৮ লাখ ছয় হাজার ৬৩৩ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট। এর বাইরে র‌্যাব উদ্ধার করেছে ৩৮ লাখ ৮৯ হাজার ৭২৬ পিস, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর উদ্ধার করেছে দুই লাখ ৫১ হাজার ৩৮৫ পিস, বিজিবি ও অন্যান্য বাহিনী এ সময়ে ইয়াবা উদ্ধার করেছে ১৪ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ পিস। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত মোট ইয়াবা উদ্ধার করা হয় এক কোটি চার লাখ পাঁচ হাজার ৬২৯ পিস।

অন্যদিকে, জুন মাস থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এসব বাহিনী ইয়াবা উদ্ধার করে এক কোটি ৩৮ লাখ ৭১ হাজার ৮৯৭ পিস। তুলনামূলকভাবে বছরের প্রথম পাঁচ মাসের চেয়ে পরবর্তী ছয় মাসে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে বেশি।

সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) বিভিন্ন রিজিয়নের বিভিন্ন ইউনিট ২০১৭ সালের পুরো বছরই ইয়াবা উদ্ধার করেছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিজিবির মাদক উদ্ধারের এক প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, ইয়াবা উদ্ধারে বিজিবি’র কক্সবাজার রিজিয়ন শীর্ষে রয়েছে। তারা এ সময়ে এক কোটি ৪৫ লাখ ৯৮ হাজার ৭৯৭টি ইয়াবা উদ্ধার করেছে। বিজিবি চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে উদ্ধার করেছে মাত্র দুই হাজার ৭০৭ পিস ইয়াবা। অন্যদিকে, ভারত সীমান্তবর্তী সরাইল অঞ্চলের বিজিবি সদস্যরা সবচেয়ে বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছেন— ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৮৫৮ পিস। রংপুর অঞ্চল থেকে উদ্ধার হয়েছে ৫ হাজার ৮৮০ পিস ও যশোর অঞ্চল থেকে উদ্ধার হয়েছে দুই হাজার ৬৪৯ পিস ইয়াবা।

এদিকে, জলসীমান্তে কাজ করা কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্যরা ২০১৭ সালে ইয়াবা উদ্ধার করেছে ১৫২ কোটি ৬৭ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ৫৪৭ পিস ইয়াবা। বাহিনী সূত্র জানায়, বছরের প্রথম ছয়মাস যে পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে, বছরের শেষ ছয় মাসে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে তার চেয়ে বেশি। তাদের উদ্ধার করা ইয়াবার বেশিরভাগই মিয়ানমার থেকে আসার সময় বঙ্গপোসাগর এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন:
শাহজালালে যাত্রীর অন্তর্বাসে ২ কোটিরও বেশি টাকার স্বর্ণের বার!

/টিআর/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কম শক্তির আবাহনীর বিপক্ষেও জিততে পারেনি মোহামেডান
কম শক্তির আবাহনীর বিপক্ষেও জিততে পারেনি মোহামেডান
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত ৮ বাংলাদেশির মরদেহ হস্তান্তর
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত ৮ বাংলাদেশির মরদেহ হস্তান্তর
গাজীপুরে দুর্ঘটনার পর ট্রেন চলাচল শুরু
গাজীপুরে দুর্ঘটনার পর ট্রেন চলাচল শুরু
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কামরাঙ্গীরচরে নতুন ভবন নির্মাণের অনুমতি দিলো ডিএসসিসি
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
কুমিল্লায় বজ্রাঘাতে ৪ জনের মৃত্যু
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ
ব্যর্থতার অভিযোগে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়ে আইনি নোটিশ