X
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
১৫ আষাঢ় ১৪৩২

ঘরছাড়া ববি এখন হিজড়াদের ঘরের ব্যবস্থা করেন

আমানুর রহমান রনি
০৬ মে ২০১৮, ০৯:৩৬আপডেট : ০৬ মে ২০১৮, ১৩:৩৭

ববি হিজড়া

ববি হিজড়া (৫৫)। রাজধানীর বাসাবো কদমতলীতে তার বাড়ি। ছেলে পরিচয়ে বড় হয়েছেন তিনি। পরিবারের সঙ্গে ছেলে পরিচয়েই ছিলেন। লালবাগ মাদ্রাসায় ছেলে পরিচয়ে লেখাপাড়াও শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন সেখানে পড়তে পারেননি। কারণ তার আত্মার ভেতর বসবাস করেছিল এক নারী চরিত্র। পুরুষের দেহের খাঁচায় যে নারীরূপ লুকিয়ে ছিল তা বের আসার জন্য ছটফট করতো, হুটহাট করেই তা প্রকাশ্য হয়ে পড়তো। 

ববির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরুষ গঠনের ববি যখন নারীদের মতো আচরণ করতে শুরু করেন তখন পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা তা নিয়ে টিপ্পনি কেটেছে প্রতিমুহূর্ত। স্কুলে গিয়ে ছেলেদের পাশে নাকি মেয়েদের সঙ্গে বসবেন তা নিয়েও ছিল নিজের সিদ্ধান্তহীনতা। ছোট্ট ববি নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু সমাজ তাকে তার মতো করে বড় হতে দিচ্ছিল না। তাই একপর্যায়ে স্কুল ছেড়ে দেন। নাচ-গান করতে ভালো লাগতো বলে এলাকায় কোনও অনুষ্ঠান হলে মেয়ে সেজে নাচ করতে যেতের। এনিয়েও তার বাবা, ভাই-বোন অনেক কথা শুনিয়েছেন। সবার অবাধ্য হয়ে তারপরও তিনি মেয়ে সেজে থাকতো। প্রতিবেশীরা ববির এমন আচরণ নিয়ে তার পরিবারকে কথা শোনাত। তখন বাবা তার পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে তাকে। এরকম প্রায় ছয় মাস বাঁধা ছিলেন ববি। এরপর বাবা মারা যায়। তখনও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে মেনে নিতে পারছিল না। তাই ১৩ বছর বয়সে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন ববি।

বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রথমে নীলক্ষেত, আজিমপুর এলাকায় লায়লা হিজড়া নামের একজনের সঙ্গে থাকা শুরু করেন। এসময় যাত্রা, মঞ্চ ও সিনেমায় নারী সেজে নিয়মিত নাচ করতেন ববি। তার আয়ও ভালো ছিল। লায়লা হিজড়াই তার গুরু-মা। তিনি আরও ১৫-১৬ জন হিজড়ার নেতৃত্ব দিতেন। ধীরে ধীরে ববি হিজড়ার সঙ্গে লায়লার সম্পর্ক দৃঢ় হয়। লায়লা হিজড়া নিজেই হিজড়াদের অধিকার আদায়ে একটি মানবাধিকার সংগঠন করেন। যার নাম ‘সুস্থ জীবন’। এই সংগঠনটি হিজড়াদের নিয়ে বিভিন্ন সচেতনমূলক ও স্বাস্থ্যগত দিক নিয়ে কাজ করে।

কয়েক বছর আগে লায়লা হিজড়া মারা যান। এরপর এই ২০-২৫ জন হিজড়া ও সুস্থ জীবন সংগঠনের দায়িত্ব চলে আসে ববি হিজড়ার কাছে। তিনি এখন এই দলটির ভালো-মন্দ সব দেখাশোনা করেন। শ্যামপুর বরাইতলায় বাঁশের ঘর তুলে বস্তি করে তারা থাকেন। গত ৩ মার্চ সেখানে ববি হিজড়ার সঙ্গে কথা হয়। আলাপচারিতায় ববি হিজড়া তার বিভিন্ন বয়সে ঘটে যাওয়া অসংখ্য অমানবিক ঘটনার কথা বলেন, যে জীবনের প্রতিটি পদেপদে বঞ্চনা, লাঞ্ছনা ও ধিক্কার ছাড়া কিছুই পাননি।

ববি হিজড়া বলেন, ‘আমরা এভাবে সৃষ্টি হয়েছি, তাতে আমাদের কোনও হাত নেই। কিন্তু সমাজ তা বুঝতে চায় না। আমি দেখতে পুরুষের মতন হলেও আমার মনের ভেতর নারী বসবাস করে। কিন্তু এটা কেউ বুঝতে চায় না। মা বাবা ভাই বোন তারাই বুঝেনি, সমাজ বুঝবে কী করে? তাই সবকিছু ছেলে চলে এসেছি যেখানে শুধু আমাদের সমাজ।’

তিনি বলেন, ‘আমার জন্য পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের কষ্ট হোক তা আমি চাই না। তাই চলে এসেছি। ওই সমাজ আমাদের না। বাবা যখন মারা যান, তারপর বাড়ি ছেড়েছি। এরপর বাড়িতে যেতাম না। মা বৃদ্ধ হয়ে ২০১৬ সালে মারা গেছেন, তখন একবার বাড়িতে গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখতে হয়েছে। কারণ আমি বাড়িতে গেলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কষ্ট পায়। তাই তাদের কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু ভাইবোনের প্রতি আমার যে দায়িত্ব সেটি সব সময় সাধ্য মতো পালন করেছি। তাদের সঙ্গে এখনও ফোনে কথা হয়। আসলে আমাদের কষ্টটা আলাদা। এটা কেউ বুঝবে না। পরিবারই বুঝল না, পাবলিক বুঝবে কী করে।’

ববি বলেন, ‘আমরা যখন ঘর ছেড়েছি, তখন হিজড়ারা এভাবে এতো দলগতভাবে চলতো না। এখন ধীরে ধীরে সহজ হচ্ছে, কিন্তু আমাদের পথ বেশি কঠিন ছিল।’

সরকার তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেওয়াতে এখনও দৃশ্যমান কোনও লাভ হয়নি হিজড়াদের-ববি হিজড়া এমনটাই দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘স্বীকৃতি পাওয়ার পর কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ মানুষ মনে করে আমরা সরকারের কাছ থেকে অনেক সুবিধা পাই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখনও আমরা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারছি না। পরিবারের সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি। তবে আগের চেয়ে একটু শক্তি হয়েছে, আইনগত স্বীকৃতি মিলেছে, তবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্নভাবে। এখন যদি কোন হিজড়া ঘর ছেড়ে আসতে চায়, তাকে আমি নিরুৎসাহিত করি। তাদের ঘরে থাকতে বলি। তাদের বুঝাই- তোমরাও পরিবারের অংশ, ছেড়ে আসবা কেন? তবে সমাজের কারণে হিজড়ারা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগে সমাজকে ঠিক হতে হবে। আমাদের মেনে নেওয়ার মতো দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। পাঠ্য বইয়ে আমাদের বিষয়ে শিশুকাল হতে সবাইকে ধারণা দিতে হবে। আমরাও মানুষ তা বুঝাতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে ঠিক হবে হয়তো।’

যারা বাসে চাঁদা তোলেন তাদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এরা আসলে আমাদের মধ্যের হলেও তাদের নতুন মনে হয়। কারো শেল্টারে তারা গ্রাম থেকে এসে পরিবহনে চাঁদা তোলে। অনেকবার তাদের অনুরোধ করেছি, কিন্তু তারা থামছেই না।’

আরও খবর:

হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’র স্বীকৃতি আছে, অধিকার নেই

যোগ্যতা থাকার পরও হিজড়া হওয়ায় সরকারি চাকরি পাননি জোনাক

 



 

/এআরআর/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় রফতানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় রফতানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
মেসিদের ৪ গোল দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পিএসজি
মেসিদের ৪ গোল দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পিএসজি
‘সব বিষয়েই একমত হতে হলে আলোচনার যৌক্তিকতা কী?’
‘সব বিষয়েই একমত হতে হলে আলোচনার যৌক্তিকতা কী?’
একদিকে গাজাবাসীকে এলাকা খালি করার আদেশ, অন্যদিকে যুদ্ধ সমাপ্তির আহ্বান
একদিকে গাজাবাসীকে এলাকা খালি করার আদেশ, অন্যদিকে যুদ্ধ সমাপ্তির আহ্বান
সর্বাধিক পঠিত
‘সবাইকে ম্যানেজ করা আছে, দুদক কিংবা কেউ কিছুই করতে পারবে না’
মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীর নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ উপপরিচালকের‘সবাইকে ম্যানেজ করা আছে, দুদক কিংবা কেউ কিছুই করতে পারবে না’
মুরাদনগরে গলায় ছুরি ধরে নারীকে ধর্ষণ, থানায় মামলা
মুরাদনগরে গলায় ছুরি ধরে নারীকে ধর্ষণ, থানায় মামলা
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
মুরাদনগরে ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় ৩ জন গ্রেফতার
মুরাদনগরে ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় ৩ জন গ্রেফতার
বাদ পড়ছেন চুন্নু, জাপার মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনছেন জিএম কাদের
বাদ পড়ছেন চুন্নু, জাপার মহাসচিব পদে পরিবর্তন আনছেন জিএম কাদের