X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকে নিঃস্ব একটি পরিবারের করুণ কাহিনি

উদিসা ইসলাম
২৫ মে ২০১৮, ২১:১৭আপডেট : ২৫ মে ২০১৮, ২২:২৮

মাদক এক ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে মধ্যবিত্ত এক মায়ের  সংসার। দুই মেধাবী সন্তান নিয়ে মায়ের আশা— ‘আর তিন বছরের মাথায় ছেলের পড়াশোনা শেষ হলেই তার টানাটানির সংসারের পালে হাওয়া লাগবে। মেয়েটি বড়, ছোটখাটো একটি চাকরি পেয়ে নিজের সংসার শুরু করেছে। এরমাঝে হঠাৎ করে ছেলের আচরণ বদলে যেতে থাকে।

বছরখানেক পরে মাদক বিক্রি করতে গিয়ে ছেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে মা জানতে পারেন— তার ছেলে মাদকাসক্ত এবং অল্পবিস্তর বিক্রিবাট্টার সঙ্গেও জড়িত। আর এরপর হঠাৎই মা জানলেন— তিনি ত্রিশ বছর ধরে যে বাড়িতে আছেন, সেই বাড়িটিও আর তার নেই। ছেলে বিক্রি করে দিয়েছে।

মাদকের কবলে পড়ে এমন নিঃস্ব হয়েছে হাজারো পরিবার। একাধিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছেলে যে মাদক নিচ্ছে, তা জানতে জানতে সময় পেরিয়ে গেছে তাকে ফিরিয়ে আনার। তারপরও চেষ্টা করা হয়েছে রিহ্যাব সেন্টারে পাঠানোর এবং সেখানে গিয়ে ছেলে ভালো হয়ে ফিরে আসবে এই আশা থেকে। কিন্তু ভালো হয়ে ফিরে আসার পর আবারও মরণনেশায় ঝুঁকেছে।

কীভাবে নিঃস্ব হলেন সেকথা বলতে গিয়ে বাড়িঘর হারানো মা রাশেদা খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একমাত্র ছেলে। পড়ালেখায় ভালো, আচরণও খারাপ ছিল না। অসৎ সঙ্গে পড়ে আচরণ খারাপ করছে বলে মনে করেছিলাম। সে যে মাদক নিতে শুরু করেছে, আমার ধারণাতেও আসেনি।ওর বাবা নাই, টানাটানির সংসার, ভেবেছিলাম হয়তো সে কারণেই মন-মেজাজ খারাপ করে।’

তিনি বলেন,  ‘যেদিন পুলিশ তাকে ধরেছে শুনলাম, সেদিন আমি জানলাম যে, সে কেবল মাদক খায় তা-না, বিক্রিও করে। জানাজানির পর শুরু হয় অশান্তি। সে আরও বেশি হিংস্র হয়ে উঠলো। টাকা চায়, দিতে না পারলে ঘরের জিনিস ভাঙে। টের পেলাম ঘরের জিনিস বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে পারিনি। একদিন সে আমার গায়েও হাত তোলে। এ মানুষটা আমার সন্তান হতে পারে না।’

রাশেদা খাতুন বলেন, ‘এভাবে বছর দুয়েক পর জানতে পারি— আমাদেরকে বাড়ি ছাড়তে হবে। এই বাড়ি দেখিয়ে সে এত টাকা ঋণ করেছে, যা শোধ করার সাধ্য আমার নেই। আর শোধ না করতে পারলে তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। আমি আর কিছু ভাবিনি, তাকে নিয়ে ছোট খুপড়ির ভাড়া বাসায় উঠেছি।’

বাড়ি কেন বিক্রি করতে হলো জানতে চাইলে মাদকাসক্ত ছেলে রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ফেনসিডিল দিয়ে এই দুনিয়ায় প্রবেশ করি। একসময় মনে হয়, এই এক বোতল ফেনসিডিল যদি আমি বিক্রি করি, কিছু বাড়তি টাকা পাওয়া যায়। তখন আমি যাদের কাছ থেকে কিনে খেতাম, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বেচাবিক্রি শুরু করি। কিন্তু আমি নিজেও যেহেতু খাই, আমার খুব বেশি লাভ হতো না। অনেক টাকা চলে যেত। পরে যাদের সঙ্গে মিলে ব্যবসায় নেমেছিলাম, তারাই আরও টাকা খাটানোর বুদ্ধি দেয়। আমার বাবার বাড়িতো একসময় আমিই পাবো, এই ভেবে একটু বেশি লগ্নি করে ইয়াবা ব্যবসায় নামতে যাই। কিন্তু মাস চারেকের ভেতরই বুঝতে পারি, লোকসানের পর লোকসানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং হাত ফাঁকা হতে শুরু করেছে।’

এখন ব্যবসা করছেন বা সহযোগী বন্ধুরা ব্যবসায় সহযোগিতা করছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখন আমি পরিবহনে কিছু কাজ করি। শিক্ষিত এবং একটু বড়লোক ভাব নিয়ে দেশের একোণা থেতে সেকোণায় মাদক নেওয়া যায়, কেউ চেক করবে না। ওরা আমাকে ভাড়ায় খাটায়। আমি ওদের চালান নির্বিঘ্নে নিয়ে যাওয়ার কাজ করি। এর বদলে কিছু টাকা, আর নিজের চাহিদার মাদক পাই। কিন্তু আমার মা আমাকে ছেড়ে যাননি। আমাদের পুরোসমাজ আমাদের ছেড়ে গেছে।’

রায়হানের বোন থাকেন রাজধানীতে। তিনি রায়হানকে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন কিনা প্রশ্নে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চেষ্টা আমরা সবাই করেছি। দিনের পর দিন মিথ্যা কথা সহ্য করেছি। সে অত্যাচার করেছে মেনে নিয়েছি। একসময় দেশের বাইরে আত্মীয়ের বাসায় থাকার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি এই ভেবে— যদি সে জীবনের মানে খুঁজে পায়। কিন্তু লাভ হয়নি।’

কেন লাভ হয়নি বলে মনে করেন জানতে চাইলে রায়হানের বোন বলেন, ‘‘ও এক ধরনের ফ্যান্টাসিতে ভুগতো। মাদক বহন করছে, অথচ কেউ ধরতে পারছে না তাকে। খুচরা ব্যবসা করে নিজের আসক্তি মেটানোর মাদক কিনছে, আবার এও ভাবছে— ‘আমি তো স্বাভাবিক আছি’। এই পরিস্থিতিতে আমরা যারাই তাকে বেরিয়ে আসতে বলেছি, তাদেরকেই সে শত্রু ভেবেছে।’

তিনি বলেন, ‘একসময় আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে তার (রায়হান) সঙ্গে কোনও ধরনের যোগাযোগ করতে নিষেধ করে দেওয়া হলো। কারণ, সে আমার শ্বশুরবাড়ি নিয়েও অনেক মিথ্যে কথা ছড়িয়ে নানা জায়গায় সুবিধা নিতে চেয়েছে। এ কারণে আমরা পারিবারিকভাবে ভুগেছিও। বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে শুনতে পেয়ে আমি মাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। কীভাবে মা সহ্য করবেন এসব। আমাদের পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর আর সুযোগ আছে বলেও মনে হয় না।’

ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিবারটি সম্পর্কে রায়হানের বোন আরও বলেন, ‘একমাত্র ছেলে বলে মা ওকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে চান না। ওরা একবেলা খেতে পায়তো আরেক বেলা পায় না। আমাদের বাবা ছিল না। ছেলেবেলা থেকেই কষ্ট করেছি, কিন্তু মায়ের আদরে রঙিন দিন কাটিয়েছি একসঙ্গে। এক মাদক আমাদের পুরো পরিবারকে বিচ্ছিন্ন তিনটা মানুষে পরিণত করেছে।’

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশ্লেষজ্ঞ ডা. তাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাদকের জন্য নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে ওঠে মাদকাসক্ত মানুষটির জন্য। সে যখন এই অর্থ সংগ্রহ করতে বেগ পায়, তখন সে যা খুশি করতে পারে। কারণ, তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। প্রথমে ছোটখাটো চুরির ঘটনা থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়া কোনোটিতেই অবাক হওয়ার কারণ নেই। আর এই পুরো কষ্টটা পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপর দিয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘বাইরে থেকে যত অভিযোগ আসে, সেগুলোর জন্য যত রকমের সামাজিক হেনস্তা, সবটাই পরিবারের সদস্যদের মেনে নিতে হয়। যখন তারা সেটা মানেন না, তখনই মাদকাসক্ত ব্যক্তিটি আরও সহিংস হয়ে ওঠেন। ফলে যে কোনোভাবে পরিবারের মাদকাসক্ত সদস্যকে সেই পর্যায়ে যাওয়া রুখতে হবে।’

অারও পড়ুন:দুর্গম সীমান্ত দিয়ে দেশে এখনও আসছে মাদক!

 

অভিযানের মুখে ডিজিটাল পদ্ধতির আশ্রয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা! 

দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৯

 মাদকের মামলায় শাস্তি কী?

 

 

/ইউআই/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
থাইল্যান্ডে সফর দুই দেশের ফলপ্রসূ অংশীদারত্বের নতুন যুগের সূচনা করেছে: প্রধানমন্ত্রী
থাইল্যান্ডে সফর দুই দেশের ফলপ্রসূ অংশীদারত্বের নতুন যুগের সূচনা করেছে: প্রধানমন্ত্রী
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি