ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর তার নেওয়া প্রায় সব উদ্যোগই থমকে আছে। তার চেষ্টায় দখলমুক্ত স্থানগুলোও আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে। আনিসুর হকের অনুপস্থিতিতে সংস্থাটিও চলছে ঢিমেতালে।
২০১৫ সালের এপ্রিলে মেয়র হিসেবে শপথ নেন আনিসুল হক। গত বছরের ৩০ নভেম্বর মারা যান তিনি। এই অল্প সময়েই বেশ কিছু নাগরিকবান্ধব উদ্যোগ নিয়েছিলেন আনিসুল হক। এর মধ্যে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা থেকে ফার্মগেট রেলগেট পর্যন্ত সড়কের অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ, আমিন বাজার থেকে শ্যামলী সড়ক পার্কিং-ফ্রি ঘোষণা, মহাখালীতে ডিএনসিসির উইমেনস হলিডে মার্কেট, হয়রানি রোধে ঠিকাদারদের বিল অফিসে পৌঁছে দেওয়া, সড়কে আধুনিক সাড়ে চার হাজার বাস সার্ভিস চালু, কাওরান বাজার ডিএনসিসি মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীদের মহাখালী ও যাত্রবাড়ীতে স্থানান্তর, সড়কে এলইডি বাতি লাগানো এবং হাতিরঝিলের আদলে রামপুরা খালের পরিবর্তন ছিল অন্যতম। কিন্তু এর প্রায় সবগুলোই তার অনুপস্থিতিতে থমকে গেছে।
মেয়র নির্বাচনের পর আনিসুল হক তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা থেকে ফার্মগেটের রেলগেট পর্যন্ত সড়ক থেকে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ওই বছরের ২৯ নভেম্বর অভিযান চালানো হয়। তখন উশৃঙ্খল মালিকদের দ্বারা তিনি আবরুদ্ধ হন। তা সত্ত্বেও তিনি পিছিয়ে আসেননি। দখলমুক্ত করে সড়কটি আধুনিকায়ন করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু তার মৃত্যুর পর সড়কটির অনেকটাই আবারও ট্রাকস্ট্যান্ডে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ট্রাকগুলো রাখার কোনও জায়গা নেই। আনিসুল হক বলেছিলেন, আমাদের জন্য একটা ট্রাক স্ট্যান্ড তৈরি করবেন। কিন্তু তাও হয়নি। এরপরও আমরা দিনের বেলায় কোনও ট্রাক রাস্তায় রাখি না।’
শুধু ট্রাকস্ট্যান্ড নয়, দখল হয়ে গেছে পার্কিংমুক্ত আমিনবাজার থেকে শ্যামলী পর্যন্ত সড়কটি। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি এ সড়কটিকে পার্কিংমুক্ত ঘোষণা করেন আনিসুল হক। কিন্তু এখন আবার আগের চিত্রে চলে গেছে। এ নিয়ে ডিএনসিসির কোনও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
ডিএনসিসির কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে সংস্থার প্রায় সব দাফতরি কাজে ধীরগতি চলছে। অবৈধ উচ্ছেদ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন কাজসহ সব কাজে ঢিলেমি চলছে। সাহস নিয়ে কোনও কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে না। ভারপ্রাপ্ত মেয়রও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সাহস পাচ্ছেন না। আনিসুল হক দুর্নীতি রোধে ঠিকাদারদের বিল তার অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেও বর্তমানে অনেক ঠিকাদারের বিল আটকে আছে। দখলদাররা ভারপ্রাপ্ত মেয়রকে ভয় পান না।
আনিসুল হক মেয়র থাকাকালে কাজের মান নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা অনেক ভুঁইফোড় ঠিকাদারকে প্রশ্রয় দিতেন না। তারা বিভিন্ন সময় মেয়রের জনবান্ধব কাজে বাধারও সৃষ্টি করতেন। কিন্তু কিছুতেই পিছু হটেননি তিনি। পেশাদার ঠিকাদার ছাড়া অন্যদের নগরভবনে ঘোরাঘুরি নিষিদ্ধও করেন তিনি।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আনিসুল হক কাওরান বাজার থেকে মহাখালী ও যাত্রাবাড়িতে কাঁচাবাজার সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। এ জন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন তিনি। ব্যবসায়ীরাও মেয়রকে সম্মতি দেন। সেই সিদ্ধান্তের আর আগ্রগতি নেই।
গত বছরের ১৮ মে নারীদের কেনাকাটার জন্য মহাখালীতে একটি উইমেনস হলিডে মার্কেট উদ্বোধন করেন আনিসুল হক। এতে নারী উদ্যোগতাদের জন্য জামানতবিহীন কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা করে ঋণের ব্যবস্থার কথা বলা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্তু মার্কেট এখন বন্ধ।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্যানেল মেয়র আলেয়া সারোয়ার ডেইজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ঘোষণা দিয়েছি যদি কোনও নারী সেখানে দোকান করতে চান তাহলে আমরা তাকে ট্রেড লাইসেন্স দেবো। সব ধরনের কাজে সহযোগিতা করবো। কিন্তু সেভাবে উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না।’
আনিসুল হকের পরিকল্পনায় ছিল সবুজ ঢাকা গঠন। এজন্য তিনি নগরজুড়ে ‘গ্রিন ঢাকা’ নামে একটি প্রকল্পও হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে সেটিও হারিয়ে গেছে।
পরিচ্ছন্নতা কাজেও দেখা গেছে ঢিলেমি। এ কাজে নিয়োজিত কর্মীদের সম্মান দেওয়াসহ সুযোগসুবিধাও বাড়িয়ে দেন আনিসুল হক। ভোর রাত থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত ঝটিকা ভ্রমণ করে পরিচ্ছন্নতা কাজসহ অন্যান্য উন্নয়ন কাজ পরিদর্শন করতেন তিনি। কিন্তু এখন নগরীর বিভিন্ন অলিগলিতে দেখা যাচ্ছে বর্জ্যের স্তূপ। ডিএনসিসির আমিন বাজার ল্যান্ডফিল নিয়েও পরিকল্পনা ছিল আনিসুল হকের। এ নিয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সেটি এখনও অনুমোদন হয়নি।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরেই সড়কে এলইডি বাতি লাগানোর পরিকল্পনা নেন আনিসুল হক। কিন্তু সে পরিকল্পনা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করলেও উত্তর সিটি করপোরেশন তা শুরুই করতে পারেনি।
উন্নয়ন কাজেও ভাটা দেখা দিয়েছে। অনেক ঠিকাদার এখন তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করেন। দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা কেটে রাখলেও কাজে জোর দিচ্ছেন না।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. জামাল মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা আনিসুল হকের সব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতনের সঙ্গে কাজ করছি। তার মৃত্যুতে ডিএনসিসি গতি হারিয়েছে— এটা ঠিক না। তবে আমরা তাকে অনুভব করছি। তিনি থাকলে ডিএনসিসিকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিতে পারতেন।’