X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাত মাসেও প্রণোদনার টাকা পাননি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা

জাকিয়া আহমেদ
২৬ অক্টোবর ২০২০, ১১:০০আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২০, ২৩:০১

করোনা টেস্ট (ছবি: ফোকাস বাংলা)

করোনা মহামারির এই সময়ে সম্মুখ সারির যোদ্ধা বলা হয় করোনা রোগীদের সেবা দেওয়া চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে। তাদের উৎসাহ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রণোদনা দেওয়ার ঘোষণা দেন। অথচ প্রায় সাত মাসের বেশি সময় পার হলেও কোনও চিকৎসক, নার্স বা স্বাস্থ্যকর্মী কেউই সেই প্রণোদনার টাকা পাননি।
একাধিক কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে কাজ করা চিকিৎসক, নার্স ও  স্বাস্থ্যকর্মীরা বলছেন,  আমরা কেউ প্রণোদনার জন্য কাজ করিনি। কিন্তু যখন সেটা সরকার প্রধান ঘোষণা দেন, তখন খুব আনন্দের বিষয় যে, আমাদের কথা রাষ্ট্র ও  সরকার মনে রাখছে। কাজের স্বীকৃতি এভাবে হলেও দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা কেউই প্রণোদনার সেই  টাকা পাইনি।

তারা বলছেন, করোনাযুদ্ধে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের এমনিতেই সম্মুখ সারির যোদ্ধা বলা হয় না, এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। পেশাগত দায়িত্ব পালন করার জন্য একজন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীকে করোনাভাইরাস আছে— এমন পরিবেশে থাকতে হয়। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সরকার প্রথম থেকেই স্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে কোনও কার্পণ্য করেনি। অথচ কোন কারণে, কোথায় এই প্রণোদনার টাকা আটকে রয়েছে, সেটা খুঁজে দেখার সময় এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছিলেন, ‘মার্চ মাস থেকে যারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছেন, আমি তাদের পুরস্কৃত করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘সরকার তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনা দেবে। এছাড়া দায়িত্ব পালনের সময় কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে তাদের জন্য ৫-১০ লাখ টাকার একটি স্বাস্থ্যবিমা থাকবে। কেউ মারা গেলে স্বাস্থ্যবিমার পরিমাণ পাঁচগুণ বেশি হবে।’

‘তবে মনে রাখবেন, এগুলো মার্চ মাসের পর থেকে যারা জীবন বাজি রেখে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে কাজ করছেন, তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে,’ উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার পর সরাসরি সম্পৃক্ত সরকারি চাকরিরত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রণোদনা হিসেবে (ডাক্তার, নার্স, টেকনোলজিস্ট, ইত্যাদি) দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করার নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এই বিষয়ে একাধিক প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর দীর্ঘ চার মাস পেরিয়ে গেছে। প্রতিটি প্রজ্ঞাপনের ওপরেই ‘অতীব জরুরি’ লেখা। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত ৯ জুলাই অবিলম্বে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এত কিছুর পরও এখন পর্যন্ত কোনও স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এই টাকা পাননি।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে এত দেরি হওয়ার কারণ কী প্রশ্ন করে তারা বলছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পাওয়া মানে বরাদ্দের বিষয়ে কোনও জটিলতা নেই। শুধুমাত্র আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেশের হাজার হাজার স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নিজেদের প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা আরও  জানান, স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকরা এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের তালিকা করতে পারেননি।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও করোনা ল্যাবে কাজ করা ডা. জাহিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা প্রণোদনার জন্য কাজ করি নাই। তাহলে তো সব কাজ থেমে থাকতো। আমরা কাজ করি দায়িত্ববোধ থেকে। ’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা পরও এত দেরি হচ্ছে এটা দুঃখজনক, আমাদের জন্য অপমানজনকও।  কারণ, প্রণোদনা দেওয়াই হয় উৎসাহ বাড়ানোর জন্য।’

‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে, করোনা শেষ হয়ে যায়নি। তাই চিকিৎসকসহ অন্যরা যদি এই প্রণোদনা পেতো, তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা আরও বেড়ে যাবে,’ বলেন ডা. জাহিদুর রহমান।

গত ৯ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগের যুগ্মসচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফের সই করা ‘করোনাভাইরাস  (কোভিড-১৯) আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় সরাসরি নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের এককালীন বিশেষ সম্মানী’ শীর্ষক পরিপত্রে বলা হয়, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সরকার এককালীন বিশেষ সম্মানী দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’

পরিপত্রে আরও  বলা হয় ‘বিশেষ সম্মানীর আওতায় শুধুমাত্র করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এককালীন দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।’

এর আগে গত ১৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক চিঠিতে বলা হয়, করোনার চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন। আর সেজন্য অধিদফতর থেকে সেদিন থেকে তিন দিনের ভেতরে করোনা রোগীদের সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যদের নাম পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়।

গত ২২ জুলাই নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদফতর থেকে অতীব জরুরি লেখা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘করোনা পরিস্থিতিতে দায়িত্বপালনরত নার্সদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন। এর  পরিপ্রেক্ষিতে রোগীদের সেবায় নিয়োজিত নার্সদের নাম, করোনায় আক্রান্ত ও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের (নার্স) নামের তালিকা পাঠাতে হবে।’

বাংলাদেশে মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) জানায়, রবিবার (২৫ অক্টোবর) পর্যন্ত করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৮৫২ জন, নার্স এক হাজার ৯৬৬ জন, আর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ২৬৬ জন।

প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে কোভিড ডেডিকেটেড প্রথম হাসপাতাল কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের সঙ্গে সবাই মজা করছে, আমরা তাতে কিছু মনে করছি না। চিকিৎসা দিচ্ছি দায়িত্ববোধ থেকে। সেবা দেবো বলেই চিকিৎসকসহ অন্যরা এ পেশায় এসেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ভালো লেগেছিল যে, আমাদের কথা রাষ্ট্র ভাবছে। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কবে হবে তাও জানি না। তবে আমরা চিকিৎসা চালিয়ে যাবো—এটাই আমাদের ধর্ম।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আরেক চিকিৎসক বলেন, খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর সেটা মনে করতে চাই না। নিজেদের মতো করে কাজ করছি।

প্রণোদনার টাকা কেন এখনও দেওয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি এখনও সেভাবেই আছে। কোভিড পরিস্থিতিতে একটু বিশৃঙ্খল অবস্থা হতে পারে। একসঙ্গে দেবে হয়তো। এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।’

‘অর্থ মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি পেন্ডিং রয়েছে’, বলেন আব্দুল মান্নান।  তবে যেহেতু ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, হয়তো একটা সমাধানের দিকে যাবে। কোভিড একটা স্বাভাবিক অবস্থায় এলে দেখা যাবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর কমিটমেন্ট ছিল চিকিৎসকদের প্রণোদনা— এটা হবেই। যে যা পাওয়ার সেটা তিনি পাবেনই। যে প্রসেসে পাওয়ার কথা, আবেদন করলেই পাবেন।’

/এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ইউনিটের প্রথম মেধাতালিকা প্রকাশ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ইউনিটের প্রথম মেধাতালিকা প্রকাশ
হার চোখ রাঙালেও সিরিজ জিতলো বাংলাদেশই
হার চোখ রাঙালেও সিরিজ জিতলো বাংলাদেশই
কাগজে হাত মুছতে গিয়ে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে রাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যু
কাগজে হাত মুছতে গিয়ে রাসেলস ভাইপারের কামড়ে রাবি শিক্ষার্থীর মৃত্যু
‘পিস্তলে বুলেট লোড-আনলোড করে বললেন, তোর কোন পায়ে গুলি করবো বল?’
‘পিস্তলে বুলেট লোড-আনলোড করে বললেন, তোর কোন পায়ে গুলি করবো বল?’
সর্বাধিক পঠিত
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
ছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাচনছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি
বৃষ্টি ও বন্যার কী পূর্বাভাস পাওয়া গেলো?
বৃষ্টি ও বন্যার কী পূর্বাভাস পাওয়া গেলো?
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা
ছুড়ে দেওয়া সব তীর সাদরে গ্রহণ করলাম: ভাবনা