রাজধানীতে ভোরে ভ্রমণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র রমনা পার্ক। ‘ঢাকার ফুসফুস’ হিসেবেও পরিচিত এটি। প্রতিদিন সকালের পাশাপাশি বিকালেও এখানে হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে আসেন কয়েক হাজার মানুষ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ধাক্কার পর ঐতিহাসিক পার্কটিতে হাঁটা ও ব্যায়ামের ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন এসেছে। আগের দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে। বহুমাত্রিকতা পেয়েছে পার্কটি।
সাম্প্রতিক সময়ে রমনা পার্কের পরিবেশ যেমন অনেকটাই পাল্টে গেছে, তেমনই বদলে গেছে এখানকার সকাল-বিকালের দৃশ্যপট। হাজার প্রজাতির গাছের এই পার্কে দুই বেলায় হাঁটা ও ব্যায়াম করতে আসা মানুষের মাঝে বৈচিত্র্য এসেছে। নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য সচেতন এসব মানুষের ক্ষেত্রে। ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে ব্যায়ামের ক্ষেত্রেও। অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে এবং অনেকে দলগতভাবে হাঁটছেন বা ব্যায়াম করছেন।
নতুন চিত্র
বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছেন। এই তালিকায় যুবক,তরুণ,তরুণীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়েও পার্কে হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে আসছেন। এ দৃশ্য বলছে, শহরবাসীর মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে।
বেশ কয়েকজন প্রাতঃভ্রমণকারী জানান, করোনার সময় পার্ক বন্ধ থাকায় মাসের পর মাস ঘরবন্দি জীবন কাটাতে হয়েছে। তাতে অনেকে মুটিয়ে গেছেন, অনেকে স্বাস্থ্যগত দিক দিয়ে সচেতন হয়েছেন। সব মিলিয়ে রমনা পার্কে সকাল-বিকালের হাঁটা ও ব্যায়ামের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন এসেছে।
যেমন আলী আজগর ও তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন বলছিলেন, নিয়মিত সকাল-বিকালে একটি নির্ধারিত স্থান পর্যন্ত হাঁটি আমরা। তারপর অন্যান্য ব্যায়াম করি। এটি রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। করোনার সময়ে এ নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে। সেই বাধা কেটে যাওয়ার পর ছেলে, পুত্রবধূ ও নাতিরাও নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়ামের প্রতি উৎসাহিত হয়েছে। আমরা একসঙ্গে পার্কে আসি।
পিছিয়ে নেই নারী-শিশুরাও
কয়েকদিনের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সব বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিদিন সকালে রমনা পার্কে হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে আসছেন। তাদের মধ্যে পুরুষ বেশি থাকলেও নারী ও শিশু-কিশোরকেও দেখা যাচ্ছে সমান তালে এগোতে। বিশেষ করে প্রতি শুক্র ও শনিবার সকালে রমনায় বিভিন্ন বয়সী নারী ও শিশু-কিশোরের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
এমনকি জুডো ও কারাতে প্রশিক্ষণে শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারীকে সমান তালে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। অভিভাবকরা বলছেন, সন্তানদের সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য এই মাধ্যমটি বেছে নিয়েছেন তারা। তাদের ক্ষেত্রে ক্যালোরিগত দিক দিয়ে এটি বেশ ভালো।
আফরোজা নাহার নামের একজন সরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘করোনার আগে আমি এবং আমার স্বামী প্রতিদিন সকালে হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে রমনা পার্কে আসতাম। এখন ছেলে-মেয়েদেরও নিয়ে আসছি। ওরা দুজনেই জুডো-কারাতে করে, আমরা ব্যায়াম করি। পরে একসঙ্গে বাসায় ফিরি।’
খোশগল্পে বয়স্করা
বয়স্ক নারী-পুরুষরা পার্কে এসে প্রথমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করেন। পরে বিভিন্ন পাকা ঘরে এবং বড় গাছের গোড়ায় তৈরি বেস্টুনিতে বসে ব্যায়াম করেন। পার্কে স্থাপিত গুচ্ছ বেঞ্চে অথবা ঘাসের ওপর বসেও ব্যায়াম করে থাকেন অনেকে। দলবেঁধে হাঁটা ছাড়াও একাকি কিংবা অন্যের সহায়তায় ব্যায়াম করতে দেখা যায় সিনিয়র সিটিজেনদের। ব্যায়াম শেষে অনেককে খোশগল্পেও মেতে উঠতে দেখা যায়।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গেলে শেখ আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের বয়স হয়েছে। অলস সময় কাটাতে হয়। সন্তানরা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর বের হওয়া হয় না। সে জন্য ব্যায়াম শেষে কিছুটা সময় বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়ে বাসায় ফিরি।
ডায়াবেটিস-প্রেসারে সচেতনতা
পার্কে প্রবেশের প্রতিটি গেটে একাধিক টেবিলে ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং প্রেসার মাপার ব্যবস্থা রয়েছে। এখান থেকে অল্প খরচে অনেকে নিয়মিত সেবা নিয়ে থাকেন। বয়স্করা ছাড়াও তুলনামূলক কম বয়সী বা যুবক-তরুণীরাও ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং প্রেসার মাপার বিষয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সেবাদানকারীরা।
তারা জানান, ব্লাড প্রেসার পরীক্ষা ১০ টাকা, ব্লাড সুগার পরীক্ষা ৩০, ইউরিন এসিড পরীক্ষা ৪০ টাকা, হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা ১০০ টাকা এবং কোলেস্টরল পরীক্ষা ১৪০ টাকা নেওয়া হয়। করোনা মহামারির পরে অনেকের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষার হারও আগের চেয়ে বেড়েছে।
গড়ে উঠেছে সংগঠন
রমনা পার্ককে কেন্দ্র করে দুই ডজনের বেশি বিভিন্ন সংগঠন গড়ে উঠেছে। যার সঙ্গে যুক্ত দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। পার্কে হাঁটতে বা ব্যায়াম করতে আসা লোকজনের দলগত উদ্যোগে এগুলো প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে ইয়োগা, জুডো ও কারাতের মতো সংগঠনও। সংগঠনগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষায় একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নাম-রমনা পার্ক ফেডারেশন অব ওয়ার্কার্স। বর্তমানে এটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন শহিদুর রহমান লাল।
তিনি বলেন, ‘৪০ বছর ধরে রমনা পার্কে হাঁটা ও ব্যায়াম করে আসছি। সব বয়সী বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ‘শতায়ু অঙ্গন’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা আগে বিভিন্ন ধরনের ব্যায়াম করলেও এখন ইয়োগা করছি। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া আশীষ কুমার আমাদের ইয়োগার কলা-কৌশল শিখিয়েছেন। এখন নিজেরাই করছি।’
যেসব সংগঠন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, তার মধ্যে রয়েছে– শতায়ু অঙ্গন, রমনা ঊষা, কিছুক্ষণ, ব্যতিক্রম, শুভক্ষণ, কণিকা, সুপ্রভাত বিক্রমপুর, উৎস, ক্ষণিকের মিলন, বকুলতলা, রমনা সূর্যোদয়, প্রভাতী, ভোরের সাথী, মাউন্টেন কেকাস, উজ্জীবন, এভার গ্রিন, নাগেশ্বর চাপা, অনুরাগ ও মহিলাঙ্গন। এখানে কাজ করছে আলফা ইয়োগা সোসাইটিসহ অনেকগুলো সংঘ, নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে রমনা জুডো ও কারাতে এবং সিতোরিউ কারাতে-দো বাংলাদেশ।
মিলছে বাজারও
রমনা থেকে বের হওয়ার প্রতিটি গেটের বাইরের অংশে রীতিমতো অস্থায়ী বাজার বসছে প্রতিদিন সকাল-বিকাল। তবে বিকালের তুলনায় সকালের বাজারে বিক্রি বেশি হয়। দোকানিরা মৌসুমি ফল, ডাব, মাঠা, বেকারি পণ্য ও মাছের ডালার পসরা সাজিয়ে বসছেন। অনেকে চাহিদামতো জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এই বাজারের বিক্রি নিয়ে দোকানিরাও বেশ খুশি।
দফায় দফায় করোনার সংক্রমণ বাড়লে সরকারের জারি করা বিধিনিষেধের আওতায় পড়ে রমনা পার্কও। বেশ কিছুদিন স্থবির থাকার পর পার্কটি চিরচেনা রূপে ফিরে এসেছে। আগের চেয়েও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তবে রমনা পার্কের শিশু কর্নারটির সংস্কার কাজের ধীরগতি নিয়ে অনেককে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।