ইরানে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ইসরায়েলি সামরিক অভিযান ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরু হওয়ার পর পরাশক্তিগুলো মেতেছে নিজেদের লাভ লোকসান পরিমাপের খেলায়। এই তালিকায় রয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া।
মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র আসাদকে হারানোর পর এখন ইরানেরও বেহাল দশা দেখে দোটানায় পড়েছে রাশিয়া। সংকট শুরু হওয়া মাত্রই দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তারা পুরো পরিস্থিতিকে আশঙ্কাজনক এবং ভয়ংকর বলে আখ্যায়িত করলেও একই সময়, নিজেদের সম্ভাব্য সুবিধাগুলোও যাচাই করে দেখছে তারা।
রুশ সংবাদমাধ্যমে দেশটির বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই সংকট থেকে কয়েকটি দিকে লাভবান হতে পারে রাশিয়া। যেমন, মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনও সংকট মানেই তেলের দাম বৃদ্ধি। সেক্ষেত্রে রুশ তেল বাণিজ্য অনেকটা চাঙা হয়ে উঠতে পারে।
এছাড়া, বিশ্ববাসী যতদিন ইরানকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, ততদিন ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে নিয়ে গালমন্দ কিছুটা হলেও কমে আসবে। এক রুশ পত্রিকা তো প্রধান শিরোনামে লিখেই ফেলেছে, ‘কিয়েভের কথা সবাই ভুলে গেছে’।
আরেকটি সুবিধা হতে পারে, পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের মর্যাদাকে সমুন্নত করার একটা সুযোগ বাগিয়ে নিয়ে সেটা কাজে লাগানো। চলমান সংকট সমাধানে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো। তাদের এই প্রস্তাব মেনে নেওয়া হলে এবং সংঘাত নিরসনে রুশ মধ্যস্থতা সফল হলে, এক ঢিলে কয়েক পাখি মারবে মস্কো। ইউক্রেনে তাদের সামরিক অভিযান সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা আনার জন্য তাদের ওপর বিশ্ববাসী কিছুটা কম আগ্রাসী আচরণ দেখাবে এবং আসাদকে হারানোর পর ওই অঞ্চলে তাদের যে প্রভাব কমে আসছিল, সেটা আবার বৃদ্ধি পাবে। এতে তারা কেবল শান্তির দূতই নয়, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র, চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আবারও গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে।
তবে ইসরায়েলি অভিযান দীর্ঘায়িত হলে লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লা ভারী হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করছেন রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আন্দ্রেই কোরতুনোভ। তিনি বলেছেন, মাত্র পাঁচ মাস আগে ইরানের সঙ্গে সামগ্রিক কৌশলগত চুক্তি করেছে রাশিয়া। অথচ তাদের ওপর ব্যাপক ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে কোনও পদক্ষেপ তারা নিতে পারলো না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, ইরানকে সামরিক সহায়তা দেওয়া তো বহু দূরের কথা, ইসরায়েলকে নিয়ে কয়েকটা রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়া ছাড়া মস্কোর কিছু করার সামর্থ্য আছে বলে মনে হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, রুশ-ইরান আলোচ্য অংশীদারত্ব চুক্তিতে সামরিক সহায়তা সংক্রান্ত কোনও শর্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ফলে, ইরানের নিরাপত্তার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে চুক্তি অনুযায়ী মস্কোর কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
তবে চুক্তিতে নিজ নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্বকারী রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইরানি প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সামরিক সহায়তার বিষয়ে আলাপ করেছেন।
সে সময় রিয়া নোভোস্তি বার্তা সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছিলেন, ইরান-রাশিয়া চুক্তিতে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য পারস্পরিক সহায়তা বৃদ্ধির বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ঘনিষ্ঠ সহায়তার বিষয়েও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছে তেহরান ও মস্কো।
তবে গত কয়েক মাস ধরে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি রাশিয়ার অনুকূলে নেই। বহু বছরের মিত্র বাশার আল-আসাদ নিজে দেশ থেকে উৎখাত হয়ে এখন রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। এদিকে, ইরানে হামলার পেছনে খামেনি সরকারকে ফেলে দেওয়ার একটা বার্তাও দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক নারীনীতিসহ বিভিন্ন কারণে খামেনি সরকারের সমালোচনার শেষ না থাকলেও ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র যুগলের প্রভাবে ইরানের সরকার পরিবর্তনে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রাশিয়া।
মধ্যপ্রাচ্যে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রুশ পত্রিকা মস্কোভস্কি কোমসোমোলেটস তাদের ১৭ জুনের সংখ্যায় মন্তব্য করেছে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে এখন ব্যাপক রদবদল দেখা যাচ্ছে। এসব পরিবর্তন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রুশ নাগরিকদের জীবনকে প্রভাবিত করবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
