X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘হাওয়া’র শালিকে হইচই, বাজারের বন্দি পাখিদের খবর কী

মাহফুজ সাদি
২৬ আগস্ট ২০২২, ২৩:৩০আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২২, ২৩:৫৮

দর্শকপ্রিয় ‘হাওয়া’ সিনেমায় ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২’ লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে রীতিমতো হইচই চলছে। কিন্তু খোদ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যপ্রাণীসহ দেদার বিক্রি হচ্ছে খাঁচাবন্দি পশু-পাখি। এ নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা নেই, দৃশ্যত তেমন কোনও পদক্ষেপও চোখে পড়ে না। এসব প্রাণীর বেলায় এই আইন কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে।

‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যে উঠে আসা একটি শালিক পাখির ইস্যুতে একদিকে কিছু পরিবেশবাদী সংগঠনের সক্রিয় হয়ে ওঠা, বন বিভাগের মামলা; অন্যদিকে টিভি অভিনয় শিল্পী সংঘ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পী ও কলাকুশলীদের সরব হওয়া। এমন প্রেক্ষাপটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর, টঙ্গী, রামপুরার বনশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকায় সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট দিনে নিয়মিত পশু-পাখির হাট বসে।

ঢাকার এসব হাটে বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার প্রাণী খাঁচাবন্দি অবস্থায় কেনাবেচা করতে দেখা যায়। পোষা প্রাণীর পাশাপাশি ময়না, টিয়া, শালিকসহ নানা ধরনের বন্যপাখিও বিক্রির অভিযোগ রয়েছে; যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এসব হাটে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের নিয়মিত অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও তা খুব একটা চোখে পড়ে না।

শুক্রবার (২৬ আগস্ট) মিরপুরের ১ নম্বরে যে পশু-পাখির হাট বসে, সেখানকার কয়েকজন ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই হাটে পোষা প্রাণী ছাড়াও ময়না, টিয়া, শালিকসহ নানা ধরনের বন্য পাখিও বিক্রি হচ্ছে। তবে এই সংখ্যাটা খুব কম। মাসে একবারও অভিযান চালায় না বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের কর্মকর্তারা। ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইন থাকলেও ক্রেতা-বিক্রেতারা তা ঠিকভাবে মানে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক আব্দুল্লাহ-আস-সাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যপ্রাণী খাঁচাবন্দি বা বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। বিষয়টি নিয়মিত তদারকি এবং বাজারগুলো ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে থাকি আমরা। তথ্য পেলে সংশ্লিষ্ট বাজার বা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়।’

মেজবাউর রহমান সুমন, (ডানে) ‘হাওয়া’ ছবির দৃশ্য

বিভিন্ন স্থানে বন্য পশু-পাখি বিক্রির অভিযোগ পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইন অমান্য করে কেউ কেউ হয়তো গোপনে বিক্রি করতে পারে। সে ব্যাপারেও আমরা সজাগ রয়েছি। বিভিন্ন সময় পরিচালনা করা অভিযানে অনেককে ধরা হয়েছে। তাদের শাস্তি ও জরিমানাও হয়েছে। আমরা কিন্তু বসে নেই।’

বন্যপ্রাণী বেচাকেনা ছাড়াও বানর-হাতি ও কুকুরসহ কিছু প্রাণী শিকলবন্দি করে রাখা এবং এসব প্রাণী দিয়ে নানা কসরত দেখিয়ে অর্থ উপার্জনের ঘটনাও দেখা যায়। এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে। কোনও ঘটনা ঘটলে হাতে গোনা দুই-চারটি সংগঠন বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকে। অবশ্য ‘হাওয়া’ সিনেমার শালিক ইস্যুতে সম্মিলিত বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। এটা ‘দ্বৈত নীতি’ কিনা প্রশ্ন করা হলে পরিবেশবাদী ৩৩ সংগঠন এবং তাদের সমন্বয়কারী বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের (বিএনসিএ) আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘আমরা কারও বিরুদ্ধে বলছি না। আমরা রাষ্ট্রের একটা আইন অবাস্তবায়িত থাকতে দেখে উদ্বেগ জানিয়েছি। বিএনসিএ শুধু আইন লঙ্ঘনের কারণে বন্যপ্রাণীরা হুমকিতে পড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এটা কোনও চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে নয়।’

হাওয়া সিনেমাটি নিজেও দেখেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি সত্যিই বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রা এনেছে। কিন্তু চলচ্চিত্রটিতে একটি শালিক পাখিকে খাঁচায় দেখানো হয়েছে। বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী দেশীয় পাখি শিকার ও কাছে রাখা অপরাধ। যেহেতু চলচ্চিত্রটিতে খাঁচায় পাখি দেখানো হয়েছে, সেটি দেখানোর জন্য একটি পাখি শিকার ও খাঁচায় রাখতে হয়েছে। আর যেহেতু বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে পাখিটি দেখানো হয়নি, এতে যে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে—সেটি স্বীকার করতে বলেছি আমরা, আর ওই দৃশ্য সংস্কার করতে বলেছি।’

সেন্সর বোর্ড আইনের বিষয়গুলো দেখলে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের ঝামেলায় পড়তে হতো না উল্লেখ করে বিএনসিএ আহ্বায়ক বলেন, ‘আইন লঙ্ঘনের অভিযোগও উঠতো না, ফলে আইন বা চলচ্চিত্র; কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। সেন্সর বোর্ড যদি প্রকাশের আগে চলচ্চিত্রটি থেকে আইন লঙ্ঘন করে দেখানো পাখির চিত্রের পরিবর্তে অনুমোদিত কোনও পাখি দেখাতে বলতো (যেমন কবুতর), বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে বলতো; তাহলে তো এই সংকট তৈরিই হতো না। যেহেতু সেন্সর বোর্ড আইনের বিষয়গুলো দেখছে না, সে কারণেই ভালো চলচ্চিত্রটিও সমালোচনার মুখে পড়ছে।’

বাজারের খাঁচাবন্দি পাখিদের ব্যাপারে সংগঠনগুলো নীরব—এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘কেবল মিরপুর বা কাঁটাবনের পাখি নয়, আমরা পরিবেশবাদীরা প্রকৃতি সংরক্ষণের বিপক্ষে প্রতিটি ঘটনাতেই প্রতিবাদ জানাই, বিবৃতি দেই। আপনি হয়তো জানেন না, এই বিএনসিএর প্রতিষ্ঠাই হয়েছিল গত বছরের অক্টোবরে হাতি হত্যার বিচার চাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই সময় আমরা বন ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছিলাম। আমরা বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদী দখল-দূষণ, বন উজাড় থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিবেশ বিধ্বংসী কাজের বিরুদ্ধে থাকি, এটাও তারই অংশ।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

তিনি বলেন, ‘আপনি কাঁটাবনে বিক্রি হওয়া প্রাণীদের বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। আমরা কোনও প্রাণীকেই খাঁচায় রেখে কষ্ট দেওয়ার পক্ষে নই। তবে কাঁটাবনের পাখিগুলো দেশীয় বন্যপাখি নয়। এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি এবং ফার্মিং করা। সবচেয়ে বড় কথা, শালিক পাখি যেমন দেশের প্রতিবেশের বড় অংশ, কাঁটাবনের পাখিগুলো তেমন নয়। দেশীয় বন্যপাখি হারালে আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। পাখিরা পরাগায়ন করে ফলমূল বা খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। তারা বিলুপ্ত হলে খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে। তাছাড়া বন্যপ্রাণী বা পাখিদের মাধ্যমে মানুষের শরীরে নানা ধরনের ভাইরাস ছড়াতে পারে, যার বড় প্রমাণ করোনা। এসব বিষয় বিবেচনায় আমরা বন্যপাখি ধরায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। তাছাড়া কাঁটাবনের পাখিগুলো যেহেতু দেশীয় নয়, এটা দেশের আইনে অপরাধ নয়। এখন আমরা দেশের আইনের কথা বলেছি। তবে আমরা কোনও প্রাণীই খাঁচায় রাখার পক্ষে নই।’

এ বিষয়ে বিএনসিএ জোটের প্রচার সম্পাদক এহসানুল হক জসীম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাওয়া ছবি নিয়ে আইনি নোটিশের সঙ্গে আমাদের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই। ২০২১ সালের শেষ দিকে বেশ কিছু হাতির মৃত্যুর খবর আসার পর ৩৩টি সংগঠন মিলে এই জোট গঠন করা হয়। আমরা হাতি, হরিণ ও বাঘ হত্যা নিয়ে প্রতিবাদ করেছি। সুনির্দিষ্ট করে পাখি নিয়ে আলাদাভাবে কাজ না করলেও বন্যপ্রাণী রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। আগামীতে পাখি নিয়েও কাজ করবো আমরা।’

এদিকে, রাজধানীর কাঁটাবনসহ বিভিন্ন এলাকায় দোকানে নানা ধরনের পশু-পাখির পসরা সাজানো থাকে বিক্রির জন্য। বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) কাঁটাবনে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধ দোকানের বিক্রির জন্য খাঁচায় খাঁচায় রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শত শত পাখি। সঙ্গে খাঁচাবন্দি রয়েছে নানা ধরনের পশুও। ঢাকার বাইরেও প্রাণী নিয়ে এমন বাণিজ্য চলছে।

কাঁটাবনের কয়েকজন দোকানদার ও বিক্রয়কর্মী জানিয়েছেন, মাঝে মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপ থেকে কেউ কেউ এসে খাঁচাবন্দি পশু-পাখিকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা, যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে কিনা, কম জায়গায় রাখা এবং অনলাইনের থেকে দোকানে বেশি দাম নেওয়ার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দোকানদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের বন্য পশু-পাখিও বিক্রি করতো। তবে আইন হওয়ার পর থেকে তারা বিদেশি পশু-পাখি বিক্রি করে আসছেন, যার মধ্যে সিংহভাগই এখন দেশে প্রজনন হয়ে থাকে। এসব প্রাণীকে খাঁচাবন্দি রেখে বিক্রি করা নিয়ে আইনি কোনও বাধা নেই। সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স এবং বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়েই এই ব্যবসা করে আসছেন তারা।

এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বন্যপ্রাণী পরিদর্শক আব্দুল্লাহ-আস-সাদিক বলছেন, এগুলো মূলত পোষা প্রাণী, বন্য নয়। বিদেশ থেকে আনা হয়, দেশেও প্রজনন হয়ে থাকে। এসব প্রাণী খাঁচাবন্দি বা বিক্রির ক্ষেত্রে আইনগত কোনও সমস্যা নেই। বরং খাঁচার বাইরে এগুলো রাখা হলে খাদ্যের অভাবে মারাও যেতে পারে।

কাঁটাবনের একুয়া অ্যান্ড পেটস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আতিয়ার রহমান রিপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা দেশের বিদ্যমান আইন মেনেই ব্যবসা করছি। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে কোনও ধরনের শাস্তি বা জরিমানার মুখে পড়েনি কোনও দোকানি। বন বিভাগ থেকে নিয়মিত খবরদারিও করা হয়। তা ছাড়া এ নিয়ে কেউ কখনও আমাদের কাছে আপত্তি করেনি।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নৈতিকতা ও পরিবেশের দিক দিয়ে প্রাণীকে খাঁচাবন্দি করে রাখার আমরা ঘোরবিরোধী। কিছুতেই এমনটি হওয়া উচিত নয়। ডমিস্ক হয়ে যাওয়া প্রাণীদের ক্ষেত্রে খুব একটা আপত্তি নেই আমার। তবে বন্যপ্রাণীকে তার মতো করে বাঁচতে দেওয়া উচিত। এটি যেন বাণিজ্যিক কারণে খাঁচাবন্দি করা না হয়।’

/ইউএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
মৎস্যঘের থেকে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো কুমির উদ্ধার
বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন্য শূকরের আক্রমণে নারীসহ ৫ কৃষক আহত
সর্বশেষ খবর
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা