দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে— এমন ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, অতিমাত্রায় আমদানি-নির্ভরতা ও ব্যাংকিং সেক্টরের অস্থিতিশীলতা দেশের অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক সংকট এই চাপকে আরও বৃদ্ধি করেছে বলেও তারা মন্তব্য করেন।
শনিবার (১২ নভেম্বর) একাত্তর টিভিতে সম্প্রচারিত ও এডিটরস গিল্ড আয়োজিত ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি: সামর্থ্য ও সংকট?’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন এডিটরস গিন্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু।
গোল টেবিল বৈঠকে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, ‘সবাই একমত হবো যে, আমরা একটা সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এখন সংকটের মাত্রা কী রকম, সেটা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। সংকটের যদি ধরনটা দেখি, এর মাঝে অনেক কিছু আছে। এটা শুধুমাত্র সামগ্রিক অর্থনীতির বিষয় না। এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি— খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ফরেন রিজার্ভ কমছে। এটাকে বলা যায়, বহুমুখী একটা সংকট। বহুমুখী সংকটকে মোকাবিলা করা অনেক জটিল। এখন সংকটের কোন দিকটা সামলাবো সেটা দেখার বিষয়। সংকট সমাধানের জন্য সরকারের পক্ষ যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে কোনগুলো গুরুত্বপূর্ণ মনে করা জরুরি, তা দেখতে হবে।’
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘সংকট নিরসনে সরকার যেভাবে হাঁটছে এলসি কমিয়ে, আমদানি বন্ধ রেখে কীভাবে ডলার কম খরচ করা যায়। আমাদের সমস্যা হয়ে গেছে, আমাদের অনেক আইটেম আমদানির ওপর নির্ভরশীল। একেবারে নিত্য প্রয়োজনীয় আইটেমগুলো আমাদের আমদানি করতে হয়। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামালের সবগুলোই আমাদের আমদানি করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাকিতেও আমরা অনেক প্রোডাক্ট কিনি। গত কয়েক বছর বাংলাদেশে অর্থনীতি খুবই ভালো ছিল। তাই এক বছরের প্রোডাক্ট বাকিতে নিয়ে আসছি। এর বিপরীতে আগামীতে ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার আমাদের পরিশোধ করতে হবে। যেটা আমরা বাকিতে এনেছি, সেটা বিক্রি করে ক্যাশও করেছি। কিন্তু এখন আমি পেমেন্ট করতে গিয়ে দেখি, ডলারের দাম বেড়ে গেছে। কিন্তু ডলার তো দরকার।’
আমদানি কমানোয় জ্বালানি সংকটে পড়েছি মন্তব্য করে জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন জ্বালানি সংকট মেটাতে আমাদের এলএনজি আমদানি করা দরকার। না হলে আমি ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যুৎ দিতে পারছি না। বা গ্যাস দিতে পারছি না। এখন ইন্ডাস্ট্রিতে যদি বিদ্যুৎ-গ্যাস দিতে না পারি, তাহলে বায়ার যদি মনে করে, বাংলাদেশে অর্ডার দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে তো সে অর্ডার দেবে না। অর্ডারটা তখন অন্য জায়গায় চলে যাবে।’
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘সংকট মোকাবিলায় আমাদের গুরুত্বের দিকটা দেখা দরকার। প্রয়োজনীয় জিনিস কোনটি সেটা বাছাই করতে হবে। চিনি প্রয়োজনীয় কিনা, সেটা ভাবার বিষয়। এটা কম ব্যবহার করা যায় কিনা। গ্রামে বিদেশি ফল, এগুলোর আদতে আমদানি করার দরকার আছে কিনা, সেটাও দেখতে হবে। এখন এই সমস্যায় সবাইকে এক হতে হবে। আমাদের শক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনটাকে গুরুত্ব দেবো।’
এ সময় তিনি ব্যাংকিং সেক্টরের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে তার সমাধানে গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন।
ব্যাংকগুলোর সুশাসনের অভাব রয়েছে জানিয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যাংকার ফারুক মইনুদ্দিন বলেন, ‘একজন শিক্ষিত লোক আমাকে জিজ্ঞেস করে, কোন ব্যাংকে টাকা রাখবো। এটা একটা অশনি সংকেত। একটা মানুষ ভরসা পাচ্ছে না কোন ব্যাংকে টাকা রাখবে। আগে অর্থনীতিবিদরা রিজার্ভ নিয়ে ভাবতো, এখন সাধারণ জনতা এসব নিয়ে ভাবছে।’
খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আমাদের স্বদিচ্ছার অভাব রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আজকে খেলাপি ঋণ যেখানে গিয়েছে, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য আমরা কোনও লিগ্যাল সাপোর্ট পাচ্ছি না। প্রত্যেকটা ব্যাংকেরই চেষ্টা আছে সুদের হার কমানোর জন্য, কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। তাহলে ঘাটতিটা কোথায়? ব্যাংকগুলো ঋণ আদায়ের চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। সিস্টেমের কাছে অসহায়। ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নাই।’
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের ব্যাংকগুলোর ডিমান্ড অব ক্রেডিট ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ইকোনমিক অব স্কেল বলে যে জিনিসটা আছে, সেটা সুবিধা পাচ্ছে না। দেশের ব্যাংকগুলোতে সুশাসন অত্যন্ত প্রয়োজন। কেননা, দেশে অতিরিক্ত ব্যাংক হওয়ার একটা কারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’
গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন— প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন।