উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণের ফলে গত বছরের অক্টোবরে নেত্রকোনায় বন্যা দেখা দেয়। এতে জেলা সদর, পূর্বধলা, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, বারহাট্টাসহ অন্তত ছয় উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিশেষ করে এসব এলাকার কৃষি, মৎস্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
তবে নয় মাস হতে চললেও ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষজন ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। সরকারি সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। ফলে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি তাদের। তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৪০ হাজার কৃষককে কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় সরিষা ও শাকসবজিসহ নানা ফসলের বীজ সহযোগিতা হিসেবে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
জেলার কৃষি, মৎস্য ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের বন্যায় জেলায় ২৪ হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমির আমন ধান, এক হাজার ৭৭ হেক্টর জমির শাকসবজি ডুবে ৭৫ হাজার ৬৯৮ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। কৃষি বিভাগ ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করেছিল ৩১৪ কোটি টাকা। কয়েক হাজার মৎস্য চাষির ছোট বড় এক হাজার ৭৩০টি ফিশারি ও পুকুরের মাছ ভেসে সাত কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়। ২০০ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা গ্রামীণ সড়ক তলিয়ে গিয়ে ক্ষতি হয়েছিল ২৫০ কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে এখনও অনেক সড়ক মেরামত করা হয়নি।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গাপুর উপজেলার কাকৈরগড়া ইউনিয়নের শুকনাকুড়ি গ্রামের কৃষক আব্দুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যায় আমার ৪ একর জমির আমন ধান তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সব জমি তলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নিঃস্ব হয়ে পড়ি। কিন্তু সরকারিভাবে কোনো রকম সহযোগিতা পাইনি আমি। কোনোভাবেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি।’
একই এলাকার কৃষক আব্দুস সাত্তার ও আমিনুল হক জানিয়েছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ওই বছর কোনও ফসলও হয়নি আমাদের। তবু কৃষি বিভাগ থেকে আমরা কোনও ধরনের সহযোগিতা পাইনি।
একই অভিযোগ করেছেন কলমাকান্দা উপজেলার বাদে আমতৈল গ্রামের মৎস্য চাষি সাইফুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বন্যায় আমার কয়েকটি পুকুরের মাছ ভেসে অন্তত ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়। ধারদেনা করে এসব পুকুরে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। সে দেনা এখনও পরিশোধ করতে পারিনি। সরকারি সহযোগিতার আশায় সংশ্লিষ্ট একাধিক দফতরে ঘুরেও কোনও রকম সহায়তা পাইনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপরিচালক মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বন্যায় কৃষকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে তাদের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৪০ হাজার কৃষককে কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় সরিষা ও শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ সহযোগিতা হিসেবে দেওয়া হয়েছে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষিদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সরকারিভাবে কোনও সহযোগিতা আসেনি। আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজখবর নেওয়া এবং পরামর্শ দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারিনি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা যে একেবারে সরকারি কোনও সহযোগিতা পাননি, তা কিন্তু ঠিক না। কারণ আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী সরকারের দেওয়া সব সহায়তা ক্ষতিগ্রস্তদের দিয়েছি। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের চাহিদার তো শেষ নেই। সরকারি সহায়তা তো নির্দিষ্ট। হয়তো তাই কিছু মানুষ না পেয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আমরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কৃষি প্রণোদনা, কৃষি ঋণ, মৎস্য ঋণসহ বিভিন্নভাবে সরকারি সহায়তা দিয়ে আসছি।’