জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসে ভাড়ায় পিকআপ চালানো শুরু করেন ভোলার দুলারহাট উপজেলার শাকিব (২০)। গত ১ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানার রায়েরবাজার এলাকার সাদেকখান বাজারে কয়েকজন যুবক মুন্সীগঞ্জ থেকে আলু আনার জন্য ৫০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে শাকিবের পিকআপভ্যান ভাড়া করে। কিন্তু কুরিয়ারের ব্যবসার জন্য পিকআপ দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিলে রাজি না হওয়ায় জীবন্ত শাকিবকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভাঙ্গাবাড়ি ব্রিজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যায় জড়িত দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
সোমবার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলা নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ঢাকা নৌ অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) গৌতম কুমার বিশ্বাস।
গ্রেফতারকৃতরা হলো—মিজানুর রহমান ওরফে সায়েম (৩৫) ও সিয়াম (২২)। এছাড়া রিয়াজ (২২) নামের অপর এক আসামি পলাতক রয়েছে। গ্রেফতারদের কাছ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত রশি, স্কচটেপ ও দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
এসপি গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, তাদের কথা মতো ৩ ডিসেম্বর বিকালে পূর্ব নির্ধারিত ঠিকানায় গেলে শাকিবকে কুরিয়ারের ব্যবসার জন্য পিকআপ দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু শাকিব রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যার ভয় দেখানো হয়। কিন্তু তাতেও রাজি না হওয়ায় তাকে হাত-পা বেঁধে জীবিত অবস্থায় বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ঘাতকরা শাকিবের সঙ্গে থাকা পিকআপভ্যানটি নিয়ে অন্যত্র সরিয়ে রাখে। নদীতে ফেলে দেওয়ার দুইদিন পর হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ লাগানো অবস্থায় গলিত লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশের মোহাম্মদপুরের বসিলা পুলিশ ফাঁড়ি।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা লাশ শনাক্ত করার পরে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌ পুলিশের বসিলা ফাঁড়ির পরিদর্শক অনিমেষ হালদারকে। দীর্ঘ ১ মাস তদন্তের পর হত্যায় জড়িত তিনজনকে শনাক্ত করা হয়।
এসপি গৌতম কুমার বিশ্বাস বলেন, শাকিব হত্যায় জড়িত তিন আসামি এক সঙ্গে রাজধানীর ধানমন্ডিতে একটি কুরিয়ারে কাজ করতো। কিন্তু কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানটি ঠিকমতো বেতন দিতো না। ফলে নিজেরাই আলাদা পিকআপভ্যান দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা করার পরিকল্পনা করে। তাদের এই ব্যবসায় পিকআপচালক প্রয়োজন হয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল মালামাল ডেলিভারি দিয়ে প্রাপ্ত কমিশনের টাকা তাকে অর্ধেক দিয়ে বাকি অর্ধেক তিন জনে ভাগ করে নিবে। পিকআপচালক যদি প্রস্তাবে রাজি হয় তো ভালো, না হলে তাকে হত্যা করে পিকআপ ছিনতাই করে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মিজানুর রহমান ওরফে সায়েম ও রিয়াজ গত ১ নভেম্বর রায়েরবাজার সাদেকখান কৃষি মার্কেটের সামনে গিয়ে ৫০০ টাকা দিয়ে শাকিবকে ভাড়ার কথা বলে টার্গেট করে।
পরে ৩ নভেম্বর শাকিবকে মিজানের বাসায় আসতে বলে। ঘটনার দিনে শাকিব পিকআপ নিয়ে মিজানুর রহমানের বাসায় সন্ধ্যার দিকে আসে। শাকিব আসলে আসামিরা তাদের ব্যবসার পরিকল্পনার কথা বলে। কিন্তু চালক শাকিব কোনভাবেই তাতে রাজি হয় না। এক পর্যায়ে মিজানের বাসায় থাকা কালো রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ও কালো স্কচটেপ শাকিবের মুখে লাগিয়ে ভয় দেখাতে থাকে। কিন্তু কোনভাবেই সে রাজি না হওয়ায় তারা তিনজন পিকআপটি ছিনতাই করার জন্য পিকআপটি চালিয়ে ভাঙ্গাবাড়ি ব্রিজের পূর্ব পাশে নদীতে আনার পর শাকিবকে জীবিত অবস্থায় নদীতে ফেলে দেয়।
পরে জিপিএস লাগানো থাকতে পারে এই সন্দেহে দুই-তিন দিন পিকআপটির কোনও খোঁজ হয় কিনা—জানার জন্য অপেক্ষায় থেকে হাবিব চেয়ারম্যানের বাড়ির বিপরীত পাশের রাস্তার ফাঁকা জায়গায় পার্কিং করে তারা তিনজন বাসায় চলে যায়। কিন্তু গত ৫ নভেম্বর পিকআপ উদ্ধার ও পরের দিন ৬ নভেম্বর শাকিবের লাশ উদ্ধারের পর আসামিরা আত্মগোপনে চলে যায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারের পর তারা হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার গৌতম বিশ্বাস বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীতে সম্প্রতি মিলছে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের লাশ। হত্যাকারীরা বুড়িগঙ্গায় কেন লাশ ফেলে যাচ্ছে তার কারণ খুঁজছে পুলিশ। নদী এলাকায় মাঝেমধ্যে আমরা কিছু পচা-গলা লাশ উদ্ধার করছি। হত্যাকারীরা বুড়িগঙ্গাকে ডাম্পিং হিসেবে বেছে নিচ্ছে কিনা—সে বিষয়ে আমরা খোঁজ নিচ্ছি। বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনাও করেছি। আমরা কিছু পরিকল্পনাও নিয়েছি।