ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, সরকারি ক্রয়ে ই-জিপি (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) প্রবর্তনের কারণে ক্রয় প্রক্রিয়া সহজ হলেও রাজনৈতিক প্রভাব, সরকারি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ত্রিমুখী যোগসাজশের ফলে এর কোনও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। উপরন্তু বিষয়টি একচেটিয়াকরণ করা হয়েছে।
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) টিআইবি কার্যালয়ে ‘সরকারি ক্রয়ে সুশাসন: বাংলাদেশে ই-জিপির কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে এসব কথা বলেন তিনি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে ই-জিপি প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর মূল লক্ষ্য, সরকারি খাতে স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক ক্রয় নিশ্চিত করা। ই-জিপির ফলে ক্র-প্রক্রিয়া সহজতর হয়েছে, প্রক্রিয়া সংক্রান্ত ব্যয় কমেছে। তবে দরপত্র জমা ও কার্যাদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে বাজার দখল ও একচেটিয়াকরণ অব্যাহত রয়েছে এবং বাস্তবে তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। এ কারণে ই-জিপির মূল লক্ষ্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সর্বনিম্ন মূল্য ও সর্বোচ্চমান নিশ্চিতের ক্ষেত্রে আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করছি না।’
তিনি বলেন, ‘টিআইবির এই প্রতিবেদনের মূল বার্তা হলো, সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ায় এক ধরনের বাজার দখল-প্রক্রিয়া মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। যদিও ই-জিপির মূল উদ্দেশ্যই ছিল এই বাজার দখলকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা। তবে ক্রয়-পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম মেনেই ক্রয় সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, সেটি আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। প্রতিযোগিতামূলক স্বচ্ছ ক্রয় এখনও পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে ৭৫ থেকে ১০০ শতাংশ ক্রয় হয়েছে একক দরপত্র বা কোনও ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই। এ ধরনের পরিস্থিতি কোনোভাবেই জনগণের অর্থের সর্বোচ্চ মূল্যপ্রাপ্তী নিশ্চিত করতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ত্রিমুখী যোগসাজশের ফলে একদিকে ই-জিপির প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে সরকারি ক্রয়-প্রক্রিয়ার ব্যাপকভাবে একচেটিয়াকরণ হচ্ছে। স্বদিচ্ছা থাকলে সরকারি তথ্যভাণ্ডারে বিদ্যমান তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ ক্রয়-প্রক্রিয়ার দুর্বলতা চিহ্নিত করে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে পারে।’
এ জন্য টিআইবি ছয়টি সুপারিশ করেছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, ই-ইজিপির আওতার বাইরে থাকা উচ্চ চুক্তিমূল্যের সব দরপত্র দ্রুততার সঙ্গে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আনতে হবে; সরকারি ক্রয়ে প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি এবং সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে আরোপিত মূল্যসীমা প্রত্যাহার করতে হবে; সীমিত দরপত্রপদ্ধতি অনুসরণের বর্তমান ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজিয়ে সরকারি ক্রয় আইন ২০০৬ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে; বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিতে এবং সম্ভাব্য যোগসাজস বন্ধে একক দরপত্র প্রবণ ক্রয় অফিসগুলোকে নজরদারির ভেতর আনতে হবে; সব ক্রয় কর্তৃপক্ষ এবং সিপিটিইউ সরকারি ক্রয়ে প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করতে হবে; একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিপূর্ণ, পক্ষপাতহীন, প্রতিযোগিতামূলক এবং সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ই-জিপির মাধ্যমে তৈরি হওয়া সুযোগ কাজে লাগাতে উপাত্ত নির্ভর বিশ্লেষণ এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে জোরদার করার মাধ্যমে পুরো ক্রয় ব্যবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।