ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে তিন কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে পদ্মা গ্রুপ অব কোম্পানির চার পরিচালকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ মামলা করেছেন পদ্মা গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান ও প্রগতি ইনস্যুরেন্স লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান খান মোহাম্মদ আমীরের মেয়ে নাজিবা নাহিম খান।
গতকাল শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) রাতে মতিঝিল থানায় বাদী হয়ে তিনি এই মামলা করেন। নাজিবা খানও পদ্মা গ্রুপ অব কোম্পানির একজন পরিচালক ও পদ্মা গ্রুপের শেয়ার হোল্ডার।
মামলায় পদ্মা গ্রুপের পরিচালক রায়হান হোসেন, পরিচালক (অপারেশন) মো. মুরাদ হোসেন সোহাগ, পরিচালক নাবিলা নাহিল খান, পরিচালক পারভীন সুলতানা খান বিউটি, অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (এস্টেট) জিয়াউদ্দিন, জিএম (অর্থ ও হিসাব শাখা) এবং পরিচালক (অর্থ ও প্রকল্প) মনির উদ্দিন। আকন সেফ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের পরিচালক আবু সামাউন সরদার; থ্রিআর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেডের এমডি মনিরা মুরাদ; ভূঁইয়া ফিশিং অ্যান্ড সন্স লিমিটেডের পরিচালক মোস্তাক হোসেন ভূঁইয়া, পরিচালক মোবাশ্বের ভূঁইয়া, পরিচালক মো. হাসমত আলী খানকে আসামি করা হয়েছে।
এ ছাড়া আনোয়ারুল ইসলাম (জামাল), আব্দুল বাসেত, মো. জামিল আক্তার, আবু তৈয়ব, কাজল, মো. ইসমাইল, মো. জহিরুল হক বিপ্লব, হাসানুল বান্না লাইলীকে আসামি করা হয়েছে।
যা ঘটেছিল
মামলার বাদী পদ্মা গ্রুপের শেয়ার হোল্ডার ও পরিচালক নাজিবা নাহিম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারা আমার বোনজামাইয়ের সঙ্গে মিলে আমার বাবার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রি করে সব নিজের নামে করে নিয়েছে। ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের কথা বলে কোটি কোটি টাকা নিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকে একটি টাকাও জমা দেয়নি। ফ্রোজেন মানি ওঠানোর কথা বলে প্রায় ৮৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। আমাদের কাছে শুধু তিন কোটি টাকার তথ্য আছে।
মামলার এজাহারে নাজিবা নাহিম খান বলেন, ‘রায়হান হোসেন, মো. মুরাদ হোসেন সোহাগ, আবু সামাউন সরদার গং জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে যোগসাজশে ‘ভূঁইয়া ফিশিং অ্যান্ড সন্স লিমিটেড’ নামক একটি কোম্পানির নাম ব্যবহার করে ওই কোম্পানির নামে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ফ্রোজেন মানি রাখা আছে জানায়। ওই টাকা উত্তোলন বা ছাড় করানোর অর্থের প্রয়োজনীয়তা আছে বলে জানায়। উল্লিখিত ১ হাজার ২০০ টাকা উত্তোলন করে সেই টাকার মধ্যে বিনিয়োগকারী হিসেবে আমাদের ৭০ শতাংশ টাকা দেবে, যা দিয়ে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে দেবে মর্মে মিথ্যা আশ্বাস ও প্রলোভন দেখিয়ে মনিরা মুরাদ, নাভিলা নাহিদ খান, পারভীন সুলতানা বিউটি, মো. ইসমাইল, জিয়াউদ্দিন, মো. জহিরুল হক বিপ্লব গং আমাদের অর্থ বিনিয়োগে প্ররোচিত করে। পরে রায়হান হোসেন, মো. মুরাদ হোসেন সোহাগ, নাবিলা নাহিল খান, পারভীন সুলতানা খান বিউটি, আবু সামাউন সরদার, মনিরা মুরাদ গং জানায় যে মোস্তাক হোসেন ভূঁইয়া, মোবাশ্বের ভুইয়া, মো. হাসমত আলী খান ভূঁইয়া ফিশিং অ্যান্ড সন্স লিমিটেড নামক কোম্পানির পরিচালক। আমি তা প্রমাণের জন্য মেমোরেন্ডাম অব আর্টিক্যালস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন (সংঘ স্মারক) উপস্থাপন করতে বললে শুধু একটি প্যাড দেয় এবং তাতে তাদের নাম ব্যবহার করে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিপত্র তৈরি করে আমাদের ভুল বুঝিয়ে ২০১৭ সালের ৩০ জুন চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।’
এজাহারে আরও বলা হয়, ‘ওই চুক্তিপত্রের সাক্ষীরা সবাই আসামিদের লোক এবং অপর আসামি মো. জামিল আক্তার ওরফে আবু তৈয়ব ওরফে কাজলকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় করিয়ে আসামি আনোয়ারুল ইসলাম জামাল ও আব্দুল বাসেতকে চুক্তিপত্র সম্পাদন ও টাকা গ্রহণের জন্য বিভিন্ন সময় অফিসে নিয়ে আসেন। তারাও ওই অপরাধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তারা আমার বিনিয়োগ করা টাকাসহ অন্যদের বিনিয়োগ করা টাকা পদ্মা গ্রুপ অব কোম্পানির কাছ থেকে ফ্রোজেন মানি উত্তোলনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ভুয়া কর্মকর্তা জামিল আকতার কাজল ওরফে আবু তৈয়বের নাম ব্যবহার করে পদ্মা গ্রুপ কোম্পানির মতিঝিলের ইউনুস সেন্টারের অফিস থেকে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা মোস্তাক ভূঁইয়া ও মোবাশ্বের ভূঁইয়াদের নাম ব্যবহার করে তাদের প্রতারক চক্রের সদস্য জনৈক কামরুল, ভূঁইয়া ফিশিং অ্যান্ড সন্স লিমিটেডের পক্ষে পদ্মা গ্রুপের ভাউচারে সই করে ওই টাকা গ্রহণ করেন। একইভাবে ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা আনোয়ারুল ইসলাম জামাল পদ্মা গ্রুপের ভাউচারে ওই টাকা গ্রহণ করেন এবং ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর মো. মুরাদ হোসেন সোহাগ নিজে ভূঁইয়া ফিশিং অ্যান্ড সন্স লিমিটেডর পক্ষে পদ্মা গ্রুপের ভাউচারে স্বাক্ষর করে ২৫ লাখ টাকা গ্রহণ করেন।’
‘এ ছাড়া পরবর্তীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ফ্রোজেন মানির ফাইল ছাড় করার কথা বলে আরও বিপুল অঙ্কের টাকা তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের জাল কাগজপত্র তৈরি করার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। চলতি বছরের ২৩ আগস্ট এ কোম্পানির জমি বিক্রি করে তারা সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেন। এই ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে পরে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদিকে ভুঁইয়া ফিশিং অ্যান্ড সন্স লিমিটেড নামক কোনও কোম্পানির অস্তিত্ব জয়েন্ট স্টকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার বাবা খান মোহাম্মদ আমির একজন বয়োবৃদ্ধ। বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হওয়ায় স্বাভাবিক চলাফেরা ও সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হওয়ায় তাকে আসামিরা বিভিন্ন কৌশলে জিম্মি করে রাখে। আসামিরা কোনও ব্যাংকের কোনও ঋণ পরিশোধ করেনি।’
আত্মসাৎ করা টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারের অভিযোগ
এজাহারে নাজিবা নাহিম খান অভিযোগ করে বলেন, ‘আসামি রায়হান হোসেন, মুরাদ হোসেন সোহাগ, নাবিলা নাহিদ খান, পারভিন সুলতানারা আত্মসাৎ করা টাকা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। আমাদের হেড অফিসের জাহাঙ্গীর আলম মুন্নাকে দিয়ে তারা এসব টাকা পাচার করেন। এই টাকা দিয়ে থাইল্যান্ড ও দুবাইয়ে বাড়ি-গাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আসামি রায়হান হোসেনের আত্মসাৎ করা টাকার একটি অংশ তার মা আঞ্জুমান হোসেনের কাছে রক্ষিত আছে এবং মুরাদ হোসেন সোহাগ দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে ১০টি লিমিটেড কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতারক চক্রের সদস্যদের ওই সব কোম্পানির পরিচালক বানিয়েছেন। আসামিরা আমার বাবাকে (খান মোহাম্মদ আমির) ভুল বুঝিয়ে আমার ও আমার মায়ের কাছ থেকে জোর করে বিভিন্ন কাগজপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।’
এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাদের মুঠোফোন নম্বরে বার্তা পাঠালেও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) বি এম রাজিবুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গতকাল রাতে মামলা হয়েছে। আজ শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) হওয়ায় এখনও এজাহারের কপি হাতে পাইনি। পাওয়ার পর এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে পারবো।’
মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এটা জাল-জালিয়াতির মামলা। বাদী কিছু ডকুমেন্টস জমা দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে। এখন আমরা এগুলো সিআইডির কাছে পাঠাবো। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। তারপর বোঝা যাবে ঘটনার সত্যতা কতটুকু। সবকিছুই এখন তদন্তাধীন রয়েছে।’