ইফতারের আর কয়েক মিনিট বাকি। ফুটপাতে ইফতার সামগ্রী বিক্রির দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। যারা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি, তারা যে যেভাবে পেড়েছেন ইফতার সামনে নিয়ে বসে পড়েছেন ফুটপাতের দোকানগুলোতে। ঠিক এই সময়টাতেও একদল পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন সড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায়। তাদের কেউ কেউ হাতে বাঁশি, কেউ লেজার লাইট হাতে, কেউ আবার হ্যান্ডমাইক হাতে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। হ্যান্ড মাইকে অনবরত পথচারীদের উদ্দেশ্যে সচেতনতামূলক বার্তা বলা হচ্ছে, কেউ আবার বাঁশি বাজিয়ে সড়ক পথচারীদের সরাতে ব্যস্ত, কেউ আবার ওয়ারলেস সেট কানে ধরে সিগন্যাল ছাড়া নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমনই চিত্র চোখে পড়লো রাজধানীর কাওরানবাজার মোড়ের সোনারগাঁও ট্র্যাফিক ক্রসিংয়ের।
রাজধানীর ব্যস্ততম এই কাওরানবাজার এলাকায় দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি কাঁচাবাজারের আড়ত। সকাল থেকে রাত, ২৪ ঘণ্টাই হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত এই এলাকায়। পাশেই দেশের অন্যতম বড় বিপণি বিতান বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্স। মোড়ের চারপাশেই গাড়ি চলাচল পথ। এসব পথ দিয়ে প্রচুর যানবাহন চলাচল করায় বরাবরই ব্যস্ত থাকতে হয় সেখানে দায়িত্বরত ট্র্যাফিক সদস্যদের। রমজান মাস আসলে ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। বিকাল হতেই সড়কে নামে মানুষের ঢল। যানজট সামলাতে হিমশিম খেতে হয় ট্র্যাফিক পুলিশ সদস্যদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনি সাধারণ সময়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড়, ধুলো-ধোঁয়া ও শব্দ মাথায় নিয়েই রাস্তায় প্রতিনিয়ত দায়িত্ব পালন করে যেতে হয় ট্র্যাফিক পুলিশ সদস্যদের। রমজান মাসেও এর ব্যতিক্রম হয় না। নগরবাসী যখন পরিবারের সঙ্গে ইফতারের সুযোগ পান, তখনও রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে এভাবেই ব্যস্ত সময় পার করেন তারা। আজান হলে কোলাহল থামে, তখন পালাক্রমে পুলিশবক্সে বসে কিংবা দাঁড়িয়েই করতে হয় ইফতার। শুধু সোনারগাঁও সিগন্যালে নয়, রমজান মাসজুড়েই ঢাকা মহানগর এলাকার প্রায় প্রতিটা মোড়েই দেখা যায় এমন দৃশ্য।
রবিবার (১৭ মার্চ) ইফতারের কিছুক্ষণ আগে কাওরানবাজারের ওই সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে ট্র্যাফিক সিগন্যালে দেখা যায় ১০ থেকে ১২ জনের একটি টিম। সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ রাখতে কাজ করছেন নিরলসভাবে। কাজের ফাঁকেই তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ইফতার প্রস্তুত করতে দেখা যায়। দ্রুত সময়ের মধ্যে মুড়ি, ছোলা, পেঁয়াজুসহ অন্যান্য খাবার মেশানো শেষে শরবত ও পানির কয়েকটি বোতল পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে রাস্তায় যারা সিগন্যালে ডিউটি করছেন তাদের হাতে। ইফতারে সময় জড়ো হয়ে তারা ইফতার সেরে নেন পথেই।
সরকারিভাবে ইফতার করতে তাদের একেক জনের জন্য একটি বেগুনি, একটি পেঁয়াজু, খেজুর, সঙ্গে ছোলা আর মুড়ি বরাদ্দ থাকে। অবশ্য নিজেদের উদ্যোগে আরও কয়েকটি ইফতারির আইটেম রাখেন তারা।
এদিন বিকাল ৪টার দিকে প্যাকেট করা এসব ইফতার নিয়ে সোনারগাঁও ওই ট্র্যাফিক বক্সে হাজির হন কনস্টেবল রফিক মিয়া। মাথাপিছু ১টি করে ইফতারের প্যাকেট বুঝিয়ে দেন দায়িত্বরত ট্র্যাফিক বক্সের কর্মকর্তাদের কাছে। ইফতার দিয়ে ফেরার পথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই এলাকার যতগুলো ট্র্যাফিক বক্স রয়েছে, প্রত্যেকটাতে আমরা ইফতারের বক্স পৌঁছে দিচ্ছি। শুধু এক মাস রমজানের জন্য আমরা এই বিশেষ ডিউটি করছি।’
দুপুর ২টা থেকে কাওরানবাজার ওই ট্র্যাফিক সিগন্যালে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ট্র্যাফিক সদস্য রশিদুল ইসলাম। রশিদুল দায়িত্ব পালন করবেন রাত ১১টা পর্যন্ত। সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে মিনিটে কয়েকবার দৌড়ে একেক সময় একেক এদিকে ছুটছেন তবুও হিমশিম খাচ্ছে যানবাহনকে শৃঙ্খলায় আনতে। তিনি বলেন, ‘আজ ২টা থেকে ডিউটি শুরু করেছি, ১১টা পর্যন্ত থাকবো। কোনও কোনও সময় কাজের চাপ থাকলে দিনে ডিউটি করার পরও আবার নাইট করতে হয়। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়! একটু আড়াল হলেই মুহূর্তের মধ্যে জ্যাম লাগিয়ে ফেলে। ফলে চাইলেও একটু বসবো, সেটা সম্ভব হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত আরেকজন সহকর্মী না আসে আমার জায়গায়, ততক্ষণ পর্যন্ত স্থান ত্যাগ করার সুযোগ নেই। একটানা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাত, পায়ে ব্যথা করে।’
রোজা রেখে কষ্ট হয় না—প্রশ্ন শুনে মুখে মৃদু হেসে বলেন, ‘কষ্ট হলেও কী আর করার, চাকরি করলে দায়িত্ব পালন তো করতেই হবে। যেদিন সকালে ডিউটিতে আসি সেদিন বাসায় ইফতার করতে পারি। এছাড়া অধিকাংশ সময় পথেই ইফতারি করি।’
সোনারগাঁও ক্রসিংয়ের ট্র্যাফিক বক্সে বসেই সামনে কয়েকদিনের ট্র্যাফিক পরিকল্পনা নিয়ে ম্যাপ ঠিক করছিলেন তেজগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্র্যাফিক) স্নেহাশিস কুমার দাস। এসময় বিভিন্ন পয়েন্টে কাজ করা ট্র্যাফিক সদস্যদের ডিউটি বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সবসময় কাজের চাপ থাকে। রমজান আসলে কাজের চাপ আরও বেড়ে যায়। অফিস শেষ যাত্রাপথে যেন কোন ভোগান্তি ছাড়া গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই আমরা দায়িত্ব পালন করছি। এজন্য ইফতারের আগে যদি যানজট মুক্ত রাখতে সকল ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা বারবার যাত্রীদের, পথচারী মাইক বলে যাচ্ছি যেন অযথা রাস্তায় ভিড় না করে, বাস থামার নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রীরা বাসে উঠেন, উল্টো পথে গাড়ি নিয়ে আসার অনুরোধ করছি। প্রতিটি ইন্টারসেকশনে আলাদা করে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। বিকালের পর থেকে কাওরানবাজার ও বসুন্ধরা সিটি শপিং মহল কেন্দ্রে করে লোকজনের ভিড় সে হিসেব করে। প্রতিটি পয়েন্ট ৬ থেকে ৭ জনের একটি টিম আমরা মোতায়েন রাখছি।’
এর আগে প্রথম রোজায় ডিএমপি কমিশনার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ট্র্যাফিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে ট্র্যাফিক পুলিশের সঙ্গে ইফতারে অংশ নেন। সেদিন যানজট নিরসনে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কর্মব্যস্ত নগরবাসী কর্মস্থল থেকে নিরাপদে যেন বাসায় ফিরে তাদের পরিবারের সঙ্গে ইফতার করতে পারেন, সেজন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে বিশেষ ট্র্যাফিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্র্যাফিক সদস্যদের সঙ্গে অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করা হয়েছে। সোনারগাঁ ক্রসিং ঢাকা শহরের ব্যস্ততম একটি স্থান। এখান থেকে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সবদিকে গাড়ি যায়। সেই হিসেবে এখানকার অবস্থা সন্তোষজনক। ইফতারের ২০ মিনিট আগে দেখা গেছে রাস্তায় তেমন কোনও চাপ নেই।’
ছবি: প্রতিবেদক