X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এই কনটেন্ট আপনি কেন বিশ্বাস করছেন

উদিসা ইসলাম
২৬ মার্চ ২০২৪, ২০:৫১আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪, ২১:১৮

দুজন উচ্চশিক্ষিত চাকরিজীবী ভীষণ চিন্তিত। ফেসবুকে ভাইরাল একটি ভিডিও কনটেন্ট দেখেছেন, যেখানে বাসে একজন নারীকে উঠতে দিচ্ছে না হেলপার। ওই নারীকে বারবার হেলপার বলছেন—এরকম বেপর্দা নারীকে আমি আমার বাসে নেবো না। এক প্রকার জোর করেই তাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরে সেই নারী আরও অনেক বাহনে উঠতে চেষ্টা করেন। কেউ তাকে নিতে রাজি না হলে ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বাসে ওঠার চেষ্টা করেন। তখন হেলপার আরও কিছু ‘নীতিকথা’ শুনিয়ে তাকে উঠতে দেন। ভিডিওটি নিয়ে সেই দুই ব্যক্তির চিন্তার কারণ—এভাবে নারীকে বাসে হেনস্তা করা হলে কীভাবে হবে এবং তাদের বিবেচনায় সেই নারী ‘অশালীন’ পোশাকও পরেননি। তাদের জানানো হয়—এটি একটি বানানো ভিডিও। আসলে এমন কিছু ঘটেনি। প্রথমে বিশ্বাস করানো না গেলেও পরবর্তীকালে বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ দিয়ে তাদের বোঝানো যায় যে এই ভিডিও বানানো এবং কিছু মানুষ নারীকে যেভাবে দেখতে চায়, নারীর চলাচল সীমিত করার জন্য, ভয় দেখানোর জন্য—এটা বানিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষিত মানুষও বিনা বাক্য ব্যয়ে কনটেন্টগুলো কেন বিশ্বাস করছেন?

ফেসবুকজুড়ে এখন নানাবিধ ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নারীবিদ্বেষী কনটেন্টের ছড়াছড়ি। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষ এসব বিশ্বাস করে। তারা এসব জায়গায় চলাচলে ভয় পাবে। এতে নারীর দৃশ্যমানতা কমবে। মানুষের মনে এ ধরনের কনটেন্ট বানানোর ইচ্ছা এমনি এমনি হয় না। যখন কিনা একাধিক ব্যক্তি কাছ থেকে এ ধরনের কনটেন্ট আসে, তখন বুঝতে হবে—একটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে কোনও একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে।

এরইমধ্যে ফ্যাক্ট-চেকার প্রতিষ্ঠান ‘ফ্যাক্টওয়াচ’ আলোচিত ভিডিওটির উৎস অনুসন্ধান করে দেখেছে যে সেটি স্ক্রিপ্টেড ছিল। অর্থাৎ, ওই ভিডিওতে দৃশ্যমান দুজন নারী এবং পুরুষ অভিনয় করছিলেন। তাদের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ওই দুজন নারী ও পুরুষ আগেও একসঙ্গে বিভিন্ন ভিডিওতে কাজ করেছেন। যেহেতু সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা ভিডিওটি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বানানো হয়েছিল এবং এটি কোনও বাস্তব ঘটনা নয়, সেহেতু ‘ফ্যাক্টওয়াচ’ আলোচিত ভিডিওটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দাবিকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে সাব্যস্ত করছে।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক নারী বাজারে গিয়ে ফলের দোকানে ফল কিনতে চেয়েছেন। ফলের দাম অত্যধিক হওয়ায় তিনি অকথ্য গালিগালাজ করে ফলগুলো দোকানির দিকে ছুড়ে ফেলছেন। ফলগুলো মাটিতে ফেলে পিষে ভর্তা করে ফেলছেন। দোকানিকে মারতে উদ্যত হচ্ছেন। নব্বই দশকের পর থেকে গার্মেন্টস শিল্প ব্যাপক হারে প্রসার লাভ করলে নারীরা রাস্তায় অতিমাত্রায় দৃশ্যমান হতে শুরু করে। এই শ্রমিক নারীরা অন্য অনেক কাজের মতো নিজেদের বাজার নিজে করে থাকেন। এখন এসে বাজারে নারীর এরকম উপস্থিতি দেখিয়ে তার বিরুদ্ধ-পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে।

বেশ কিছু নারীবিদ্বষী ভিডিও কনটেন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। অনেকে বিশ্বাসও করছেন। এতে কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করেন—জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ব্রিস্টল ল স্কুলে পিএইচডি গবেষক অর্পিতা শামস মিজান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারীবিদ্বেষ বাংলাদেশের সমাজে নতুন না। এই যে সামাজিক মাধ্যমে এখন চোখে পড়ার মতো মাত্রায় নারীবিদ্বেষী কন্টেন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে, এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি যে বাংলাদেশের পাবলিক ডিসকোর্সে এখন সোশ্যাল মিডিয়া আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। ফলে, বাস্তব জগতের আলাপ, ধ্যান-ধারণা এখন ফেসবুক রিল, ইন্সটাগ্রাম ভিডিও, টিকটক ইত্যাদির মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতেও উঠে আসছে। এর ক্ষতি বহুমাত্রিক। প্রথম ক্ষতি হচ্ছে—নারীদের ক্ষমতায়নকে এসব ভিডিও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে মানুষকে ভুল বার্তা দিচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন মানে পুরুষদের হেরে যাওয়া, নারী পুরুষের সহযোগী নয়, বরং পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী—এভাবে নারীদের একটি শত্রু হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে।’ তিনি মনে করেন, এর ফলে অপতথ্য বেড়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমাদের দেশে ডিজিটাল লিটারেসি খুব কম, ফলে অনেকেই এসব ভিডিওকে অনুকরণীয় মনে করছেন। অনেকেই এসব ভিডিও দেখে নারীদের হয়রানি করার নতুন আইডিয়া পেয়ে সেগুলোকে বাস্তবায়িত করতে চান। ফলে নারীদের রাস্তাঘাটে, অফিসে, বাজারে, এমনকি পরিবারেও বাস্তবিক নিরাপত্তা ধীরে ধীরে কমছে।

অর্পিতা বলেন, ‘এর ফলে অনেক নারী, বিশেষ করে যারা যৌন নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির সারভাইভার, তাদের মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। অনেকেই পুনরায় ট্রমার শিকার হচ্ছেন।’

সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষতি হচ্ছে আমাদের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে। এসব কনটেন্টের মাধ্যমে যে ধরনের ক্ষতি এবং যে ধরনের অপরাধ হচ্ছে, আমাদের আইন প্রণয়নকারী সংস্থা এবং আমাদের বিচার ব্যবস্থা এসবের মোকাবিলা করতে অভ্যস্ত না। ফলে এখানে এই গুরুতর বিষয়গুলোকে লঘু করে দেখার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। যার সুদূরপ্রসারী ফল নারীর প্রতি সহিংসতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

নারীবিদ্বষী অনেক ভিডিও কনটেন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। এতে নারীর দৃশ্যমানতা হুমকির মুখে পড়বে কিনা—প্রশ্নে গবেষক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘এবারে রমজানের সময় এই প্রবণতা বেড়েছে। কনটেন্ট ক্রিয়েটররা ভিউ বাড়াতে জনতুষ্টিমূলক নীতি-পুলিশিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, প্রচার করছে। হজরত খাদিজা ঘরের বাইরে ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। বর্তমান সময়ে নারীকে ঘরবন্দি রাখলে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন গার্মেন্টসে কর্মরত নারীরা। এসব নারীবিদ্বেষী নীতি-পুলিশি প্রতিহত করা দরকার।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
সর্বশেষ খবর
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: বিচারের অপেক্ষায় এক দশক পার
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: বিচারের অপেক্ষায় এক দশক পার
জাতীয় পার্টির (কাদের) কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভা শুরু
জাতীয় পার্টির (কাদের) কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভা শুরু
লোহিত সাগরে এন্ড্রোমিডা স্টার জাহাজে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
লোহিত সাগরে এন্ড্রোমিডা স্টার জাহাজে হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
‘আমার স্ত্রী শুধু অন্যের পরামর্শ শোনে’
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!