এমনিতেই রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটগুলোতে পশু ও ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না, তার ওপর ইদানীং যুক্ত হয়েছে ইউটিউবার ও টিকটকারদের ভিডিও ধারণের উৎপাত। এতে অতিষ্ঠ ক্রেতা-বিক্রেতারা। এসব হাটে ক্রেতার চেয়ে এখন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের সংখ্যাই বেশি দেখা যায়।
তারা বিভিন্ন ধরনের পশু ও পশুর দরদাম নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করেন। পশুর প্রকৃত দাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নামে-বেনামে বিভিন্ন চ্যানেল ও আইডিতে আপলোড করেন। এসব ভিডিও দেখে হাটে গিয়ে অনেকটা বিপাকে পড়তে হচ্ছে ক্রেতাদের।
এ ছাড়া এসব ইউটিউবার ও টিকটকারের প্রলোভনে বিভিন্ন মডেল ও পরিচিত ব্যক্তিদের নামে পশুর নামকরণ করছেন অনেকে। ‘পরিমনি’, ‘শাবিক খান’, ‘জায়েদ খান’, ‘মেসি’সহ নানা নাম দিয়ে তারা কোরবানির পশুর অতিরিক্ত দাম হাঁকছেন বলে অভিযোগ আছে। আবার অনেকে মালিকের চাওয়া দামের চেয়েও কম জানিয়ে ভিডিও তৈরি করেন। মূলত ভিডিওর ভিউ (দর্শক) বাড়াতে ইউটিউবার ও টিকটকাররা এমন অযাচিত কাজ করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটে ইউটিউবার ও টিকটকারদের আনাগোনা কয়েক গুণ বেড়েছে বলে জানান পশু ব্যবসায়ী ও হাট পরিচালনাকারীরা।
শুরুতে এসব ইউটিউবার বিক্রেতাদের কাছ থেকে গরুর বিবরণ জেনে নেন, তখন ভিডিও ধারণ করেন। আবার ক্রেতা গরু কিনে ফেরার পথে থামিয়ে দাম জিজ্ঞাসা করার সময়ও ভিডিও ধারণ করেন। পরে এস নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করে আপলোড করেন। তবে এ বছর বিষয়টি মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে উল্লেখ করে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন অনেক ক্রেতা-বিক্রেতা।
তাদের অভিযোগ, অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব ভিডিওতে অংশ নিতে হচ্ছে তাদের। আর ইউটিউবারদের দাবি, হাটের পরিস্থিতি ও পশুর প্রকৃত দাম জানাতেই তারা ভিডিও তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেন। দর্শকরা কোরবানির পশু কিনতে হাটে আসার আগে এসব ভিডিও দেখে বাজারের পরিস্থিতি জানতে পারেন।
শুক্রবার (১৪ জুন) রাজধানীর গাবতলী ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার পশুর হাট ঘুরে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক মোবাইল হাতে নিয়ে কোরবানির পশু নিয়ে ভিডিও করছেন। তারা হাটে পশুর ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং গরুর ভিডিও ধারণ করছেন। আবার কেউ কেউ হাটের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পশু কিনে নিয়ে যাওয়ার সময় ক্রেতাদের দাঁড় করিয়ে পশুর দাম জানছেন।
গাবতলী পশুর হাটে দেখা যায়, লুঙ্গি পরে কোরবারির পশুর সামনে কয়েকজন যুবক মোবাইল দিয়ে টিকটকের ভিডিও বানাচ্ছেন। জানতে চাইলে মিরাজ নামে এক যুবক বলেন, ‘এমন ভিডিও মানুষ বেশি খায় (দেখে)। তাই গরুর সঙ্গে কিছু ফানি ভিডিও বানাচ্ছি।’
গাবতলী হাটের গেটের সামনে দেখা মেলে একাধিক ইউটিউবার ও টিকটকারের। কোরবানির পশু কিনে বের হয়ে যাওয়ার সময় তারা ক্রেতাদের দাঁড় করিয়ে পশুর দাম ও বিবরণ জানার চেষ্টা করছেন।
কেন এমন করছেন, জানতে চাইলে আব্দুল আলীম নামে এক ইউটিউবার বলেন, ‘আমাদের অনেকগুলো ইউটিউব ও ফেসবুক চ্যানেল আছে। আমরা বিভিন্ন সময় ইস্যুভিত্তিক কাজ করে থাকি। এখন আমরা কোরবানির পশুর হাট নিয়ে ভিডিও বানাচ্ছি।’
অযাচিত কন্টেন্ট বা ভুল তথ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ফেক ভিডিও বানাই না। আমাদের ভিউয়ার (দর্শক) এসব ভিডিও দেখতে চায়। কোন হাটে পশুর দাম কেমন! কেমন দামের পশু বেশি, বাজেটের মধ্যে আছে কি না! তারা এসব জানতে চায়। তাই আমরা এসব নিয়েই ভিডিও তৈরি করছি।’
রাজু নামে এক ইউটিউবার বলেন, ‘অনেকে আছে যারা বেশি ভিউর জন্য ফেক ভিডিও তৈরি করে। হাটের প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভুয়া তথ্য প্রচার করে। কিন্তু আমরা এমন না। যা সত্য তা-ই আমরা তুলে ধরি।’
মানিকগঞ্জের সিংগাইর থেকে লাল রঙের প্রায় ২২ মণ ওজনের একটি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসছেন ব্যাপারী আলাল মিয়া। তিনি তার গরুর নাম রেখেছেন ‘লালসাই’। তিনি বলেন, ‘আমার লালসাইয়ের (গরু) দাম চাচ্ছি ১৫ লাখ টাকা। অনেক ক্রেতা এসে বলছেন, তারা ইউটিউবে দেখেছেন গরুর দাম ১০ লাখ টাকা। আমি এমন দাম কখনই বলিনি। বর্তমানে গরুর খাবারের অনেক দাম। লালন-পালনে অনেক খরচ পড়ে যায়।’
ইউটিউবার-টিকটকারদের জন্য হাটের বেচাকেনার কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে গাবতলী হাট পরিচালনাকারী সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটা খুব একটা সমস্যা না। এখন সবার হাতে স্মার্টফোন আছে। অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ভিডিও বানাচ্ছে। সাংবাদিকরা আসছেন, নামে-বেনামে ইউটিউব, ফেসবুক চ্যানেলের লোকরা এসে ভিডিও বানাচ্ছেন। আমরা কাউকে নিষেধ করছি না। এটা তাদের ব্যাপার।’
একই চিত্র দেখা যায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট মাঠের হাটে। এখানেও মোবাইল হাতে অনেক যুবক কোরবানির পশুর ভিডিও ধারণ করছেন।
‘ড্রিম কাউ’ নামে এক ইউটিউব চ্যানেলের কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ফাহাদ বলেন, ‘কোরবানির পশুবিষয়ক ভিডিও অনেক বেশি ভিউ হয়। ভালোই চলছে আমাদের চ্যানেলের ভিডিও। আমি বিভিন্ন হাটে গিয়ে ভিডিও তৈরি করি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট হাটের পরিচালনাকারী সদস্য মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাটের স্বেচ্ছাসেবকদের বলা আছে, যারা ব্যাপারী ও ক্রেতাদের সমস্যা সৃষ্টি করবে, তাদের হাট থেকে বের করে দেওয়া হবে। আমাদের হাটে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ ক্লিয়ার রাখছি; যাতে হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের কোনও বিড়ম্বনা না হয়।’