সাধারণ মানুষের ধারণা রাজধানীতে বিভিন্ন পণ্যের বাজারে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে, কিন্তু মাঠের চিত্র ভিন্ন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, হাত বদল হয়েছে মাত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি, চাঁদাবাজ মানুষগুলোর চেহারা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। সারা দেশের সঙ্গে রাজধানীর বড় পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত কাওরান বাজারের চিত্রও ভিন্ন নয়। এ বাজারে চাঁদাবাজির হাতবদল হয়ে সবই চলছে আগের মতো। কাওরান বাজারের বড়-ছোট একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে পুরো কাওরান বাজারে বিভিন্ন খাতের অজুহাতে চাঁদাবাজি করতেন আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান হোসেন। লোকমানের প্রধান সহযোগী ছিলেন রনি নামে একজন নিজ দলের জুনিয়র কর্মী, সঙ্গে ছিলেন আরও কয়েকজন। ৪ আগস্ট বিকালের পর থেকে লোকমানকে আর দেখা যায়নি, নেই রনিরাও।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এর দুদিন গ্যাপ দিয়ে তৃতীয় দিন থেকেই কাওরান বাজারের দখল নেয় তেজগাঁও এলাকার বিএনপি নেতা (সাবেক যুবদল নেতা) সাইফুল আলম নীরব। শুরুতে মিছিল, পরে দলীয় জনসংযোগ করে জানান দেওয়া হয় নিজেদের অস্তিত্ব। এরপরেই শুরু হয়েছে নীরবের নিরব চাঁদাবাজি; যা এখনও চলছে। তিনি নিজে প্রকাশ্যে না এলেও যুবদল নেতা আব্দুর রহমানসহ দলীয় ছোটখাটো ও মাঝারি মানের কর্মীদের দিয়ে চলছে তার এই কর্মকাণ্ড। বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিনিধির কাছে এমন অভিযোগই করেছেন কাওরান বাজারের বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীরা। যদিও বিএনপি বিশেষ করে যুবদল থেকে আব্দুর রহমানকে ইতোমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে।
রাজধানীর কাওরান বাজারের বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সবজি থেকে শুরু করে মশলার বাজার, মাছের বাজার এমনকি সেখানকার ফার্নিচার মার্কেট, কামারপট্টি, চালের বাজার এবং কিচেন মার্কেটকে ঘিরে চলে এই চাঁদাবাজি। কাওরান বাজারের আশপাশের সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চৌকি বসিয়ে ভাসমান বাজার সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিটি চৌকির বিপরীতে ধার্য করা আছে চাঁদার পরিমাণ। নির্দিষ্ট হারে টাকা দিলেই মেলে চৌকি বসানোর অনুমতি। এই চৌকি আগেও বসেছে, এখনও বসে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে পাইকারি ব্যবসায়ীদের ট্রাক ভর্তি করা পণ্য কাওরান বাজারে খালাস করতে দিতে হতো চাঁদা। লোকমানের প্রতিনিধি হিসেবে রনি এই সব ট্রাক থেকে চাঁদা তুলেছেন। এই চাঁদা আদায়ের জন্য প্রথমে পণ্য ভর্তি ট্রাকটিকে নিয়ে যাওয়া হতো কিচেন মার্কেট সংলগ্ন আম্বর শাহ মসজিদের সামনে। সেখানেই চলতো দেনদরবার। দেন দরবারে ফয়সালা না হলে পুরো ট্রাকের পণ্য ছিন্নভিন্নভাবে লুট হয়ে যেতো। ট্রাকের পণ্য কে বা কারা নিয়েছে, তার কোনও হদিস মিলতো না। লোকমানের কাছে নালিশ নিয়ে গেলে তিনিও বলতেন, ভেজাল পণ্য এই বাজারে বিক্রি করা যাবে না। তবে ট্রাকভর্তি পণ্যের মালিক লাখ লাখ টাকার পণ্য হারানোর ভয়ে লোকমানদের দাবি অনুসারে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে ট্রাক নিজের দখলে নিতে বাধ্য হতেন। পণ্য খালাসের এই নিয়মে এখনও দিতে হয় চাঁদা। নইলে হারাতে হয় ট্রাকভর্তি পণ্য।
এখানেই শেষ নয়, কিচেন মার্কেটের নিচতলা ও দোতলায় পাইকারি পণ্যের দোকান রয়েছে। যেখানে মূল পাইকারি বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে। এই মার্কেটের তিন তলায় রয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদাম। সেখানে প্রতিটি গুদামের সামনে নিরাপত্তার অজুহাতে একটা ১০০ পাওয়ারের বাল্ব লাগানোর নির্দেশনা দেওয়া হতো লোকমানের আমলে। প্রতিটি গুদামের সামনে বাল্ব লাগানো প্রয়োজন না হলেও এটি ছিল সব গুদাম মালিকের জন্য বাধ্যতামূলক। প্রতিটি বাল্বের বিপরীতে মাসে আদায় করা হতো এক হাজার টাকা।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাল্ব না লাগালেও প্রত্যেক গুদাম মালিককে চাঁদার টাকা পরিশোধ করতেই হতো— এটি ছিল অলিখিত নিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে এটি বন্ধ রয়েছে, তবে এটি চালু করার তৎপরতাও অব্যাহত রয়েছে। মার্কেটে সেনাবাহিনীর টহল থাকার কারণে তা পুরোপুরি চালু করতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, সেনাবাহিনীর টহল বন্ধ হয়ে গেলে এই চাঁদাবাজি আবার শুরু হবে।
অভিযোগের বিষয়ে শুক্রবার রাতে কথা হয় সাইফুল আলম নীরবের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আসলে এসব নিয়ে মন্তব্য করতেই চাই না। এটা নিয়ে এত কথা বলেছি। আমার এখানে (কাওরান বাজারে) দোকান নাই, কিছু নাই, ব্যবসা নাই; কিন্তু তারপরও আমার নাম জড়ানো হচ্ছে।’
ব্যবসায়ীদের অভিযোগে বিষয় তুলে ধরলে তিনি বলেন, ‘দেখান কোনও তথ্য প্রমাণ, আমি কীসে যুক্ত।’
গত ৭ জুলাই সাইফুল আলম নীরবকে আহ্বায়ক ও আমিনুল হককে সদস্যসচিব করে ঢাকা মহানগর উত্তরের আংশিক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আড়াই মাস পর গত ২৮ সেপ্টেম্বর সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ওইদিন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আহ্বায়ক কমিটির বিরুদ্ধে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিভিন্ন অভিযোগের কথা বললেও স্থানীয় নেতারা বলছেন, আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেওয়ার অন্যতম কারণ চাঁদাবাজির অভিযোগ।
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, কাঁচাবাজারে কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে তেজগাঁও থানা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব মো. আব্দুর রহমানকে বহিষ্কার করেছে যুবদল। ঘটনার নেপথ্যের ইন্ধনদাতা হিসেবে আরও এক নেতার নাম উঠে এসেছে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। চাঁদাবাজির সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তাকেও বহিষ্কার করা হবে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবদলের এক নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘যে নেতার বিষয়ে তদন্ত চলছে তিনিই সাইফুল ইসলাম নীরব।’
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাইফুল আলম নীরব বলেন, ‘অবশ্যই রাজনৈতিক কারণ আছে। এখানে আমার কিছুই নাই, অথচ এটাতে আমার নাম যুক্ত করা হচ্ছে।’
তথ্য বলছে, ঢাকা মহানগর যুবদল উত্তরের সদস্যসচিব সাজ্জাদুল মিরাজের মদতে তেজগাঁও থানা যুবদলের বহিষ্কৃত সদস্যসচিব আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে কাওরান বাজারকে কয়েকটি স্পটে ভাগ করে আদায় করা হয় চাঁদা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেউই মুখ খুলতে চান না। মুখ খুললেও নাম প্রকাশ করতে চান না। কিচেন মার্কেটের একাধিক পাইকারি ব্যবসায়ী বাংলা ট্রিবিউনের কাছে কাওরান বাজারের চাঁদাবাজির নানাবিধ ধরন সম্পর্কে অবহিত করলেও সরাসরি কেউই মন্তব্য করতে সাহস দেখাননি। কারণ জানতে চাইলে তাদের একজন বলেন, ‘আপনি সাংবাদিক মানুষ, আপনাকে এ বাজারে না এলেও চলবে। কিন্তু আমাদের প্রতিদিনই এসব সমস্যা মোকাবিলা করে ব্যবসা করতে হবে। কাজেই আমরা চিহ্নিত হয়ে গেলে প্রাণনাশের ঝুঁকি আছে।’
একই কথা বলেছেন কাওরান বাজারে কিচেন মার্কেটের সামনে চৌকি পেতে ডাবের ব্যবসা করা ক্ষুদে ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিদিন ৬০০ টাকা চাঁদা দিয়ে দোকান খুলি। যেদিন দিতে না পারি, সেদিন ব্যবসা বন্ধ থাকে। সকাল ১০টার দিকে একজন এসে এই টাকা নিয়ে যায়, তারপরেই চৌকি বসাই, এর আগে নয়। তাকে ৬০০ টাকা না দিয়ে চৌকি পাতলে তুলে দেয় বলেও জানান ওই ক্ষুদে ব্যবসায়ী। চাঁদা আদায়কারীর নাম জানেন না বলেও জানিয়েছেন আব্দুল আলিম।
তেজগাঁও থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, অনেকের নামেই অভিযোগ শুনছি। তবে তদন্তে প্রমাণিত হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। যাদের নামে অভিযোগ শোনা যায়, তারা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলেও জানিয়েছেন পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, শুধু কাওরান বাজারেই নয়, দেশের যেকোনও পণ্যের বাজারে চাঁদাবাজি হলে সরকার ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে। সরকারের সবগুলো উইং কাজ করছে। এখন আর আগের মতো চাঁদাবাজি নেই।