X
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২
দুর্নীতির অভিযোগ

এবার ৪ মামলার আসামি বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী

ইমরান আলী
২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:০০আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:২৪

দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলা অবস্থায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে এবার চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা চার মামলার আসামিদের মধ্যে অন্যতম আসামি হলেন বেবিচকের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। অথচ গত নভেম্বরের শেষের দিকে তার নিয়োগের সময় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। এছাড়া এই হাবিবুর রহমানকে সিভিল এভিয়েশনের দুর্নীতির ‘বরপুত্র’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

তবে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’

তার নিয়োগের সময় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, দুদক তদন্ত করছে— এ রকম একজন ব্যক্তিকে কোনোভাবেই পদোন্নতি দিয়ে প্রধান প্রকৌশলী করা ন্যায়সঙ্গত হয়নি। যারা তাকে পদোন্নতি দিয়েছেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে দুদকে বেবিচক কর্মকর্তাদের একটি লম্বা তালিকা পাঠানো হয়। ওই তালিকায় কর্মকর্তাদের বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে কিনা এবং অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত হচ্ছে কিনা— তা জানতে চাওয়া হয়। ওই তালিকার ১২ নম্বরে নাম ছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এবং বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী হাবিবুরের নাম।

সেই চিঠির প্রেক্ষিতে গত ২৪ অক্টোবর দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিনের সই করা ফিরতি চিঠিতে পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, ‘প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানের দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছে কমিশন। ইতোমধ্যে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাও নিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া গত ১৫ নভেম্বর অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপ-পরিচালক নাজমুল হাসান দুর্নীতির এই অভিযোগ সম্পর্কে হাবিবুর রহমানকে দুদকে ডেকে এনে তার বক্তব্যও শোনেন।’

দুদকে দায়ের করা অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, চাকরি জীবনের শুরু থেকে নানাভাবে অন্যায়-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। চাকরি জীবনে তিনি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

মূলত তত্তাবধায়ক প্রকৌশলী থাকা অবস্থায় বেবিচকের বড় বড় প্রকল্পের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। আর এই জড়িত থাকা অবস্থায় ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন বলে অভিযোগ আছে। 

দুদকের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তিনি যখন যে প্রকল্পে ছিলেন, অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার কারণে প্রকল্পগুলো একের পর এক মুখ থুবড়েও পড়ে।’

‘কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণে জমি অধিগ্রহণের সব প্রক্রিয়া শেষ করে অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্য বাবদ সরকারিভাবে ৫০ কোটি টাকা দেওয়া হলেও ঘুষ-বাণিজ্যের আশায় সেই চেক ছাড়তে দেরি করেন তিনি। এর ফলে একপর্যায়ে পিছিয়ে যায় জমির অধিগ্রহণ। পরবর্তী সময়ে অধিগ্রহণ মূল্যবাবদ তিন গুণ মূল্য পরিশোধের সিদ্ধান্ত আসে সরকারিভাবে। এতে করে ১০০ কোটি টাকার লোকসান গুণতে হয় সরকারকে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হলে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে প্রকল্পের দেখভাল করার দায়িত্ব থাকলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে রেহাই পান হাবিবুর রহমান।’ 

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ‘কূটচালে বিভিন্ন প্রকল্পের পিডি হিসেবেও অতিরিক্ত দায়িত্ব নেন হাবিবুর। এরকম তিনটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে— কক্সবাজার, সিলেট এবং চট্রগ্রাম বিমানবন্দর রানওয়ে এবং টেক্সিওয়ে শক্তি বৃদ্ধিকরণ শীর্ষক প্রকল্প। নিয়মানুযায়ী, প্রকল্প পরিচালকের প্রকল্প এলাকায় থাকার কথা থাকলেও এই তিন প্রকল্পের কোথাও তিনি থাকেননি। এসব প্রকল্প থেকে তিনি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।’

দুদক সূত্র বলছে, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনালে বিনা টেন্ডারে ১৬ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজেও তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ধরা পড়ে। এখান থেকেও বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন।’

‘কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন কাজের পিডি থাকাকালে তার বিরুদ্ধে দরপত্রে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ার পর তাকে পিডি পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সিভিল সার্কেল-১ এর দায়িত্বে থাকাকালে অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও খামখেয়ালীর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুদক থেকে তকে বেবিচকের কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে দায়িত্ব না দিতে বলা হয়।’

‘এরপরও বিভিন্নভাবে কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি বিমানবন্দর উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব পান প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। এর মধ্যে রয়েছে সরকারের মেগা প্রকল্প খান জাহান আলী বিমানবন্দর উন্নয়ন, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নয়ন, ওসমানী বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের রানওয়ে ওভারলেকরণ এবং প্যারালাল টেক্সিওয়ে নির্মাণ, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান টার্মিনালের সম্প্রসারণ নবরূপায়ণ এবং কক্সবাজার বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ ও রানওয়ে সম্প্রসারণ। এসব কাজে নানাভাবে অনিয়ম দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ এই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে।’

দুদকের সূত্র বলছে, ‘‘ঠিকাদারের সঙ্গে বিলের পারসেন্টেজ নিয়ে ‘বনিবনা’ না হওয়ায় কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে রানওয়ের শক্তি বৃদ্ধিকরণ কাজের বিল আটকে রাখার অভিযোগ উঠে হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তাকে প্রত্যাহার করা হয় পিডি পদ থেকে।’ বেবিচক সদর দফতরের ভবন নির্মাণ প্রকল্পেরও বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ছিলেন হাবিবুর রহমান।

এ কাজেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে অহেতুক বিলম্ব করতেন। ঠিকাদারের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে  দেনদরবারের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পরই সিদ্ধান্ত আসতো তার কাছ থেকে। ফাইল আটকে রেখে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ বাণিজ্য করতেন। এক পর্যায়ে বিষয়গুলো জানাজানি হলে হাবিবুরকে সরিয়ে দেয়াও হয় এই প্রকল্প থেকে।

অভিযোগে হাবিবুর রহমানের বিষয়ে দূর্নীতির বিস্তর বর্ননা দিয়ে তাকে বেবিচকের দুর্নীতির ‘বরপুত্র’ বলে অভিহিত করা হয়।

তবে অভিযোগ ও মামলার বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন না বলে জানান।

প্রসঙ্গত, তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে সোমবার (২৭ জানুয়ারি) চারটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ এসব মামলা দায়ের করা হয় বলে জানিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।

তিনি বলেন, ‘ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির মাধ্যমে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।’

দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা-বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মুহিবুল হক, সাবেক যুগ্ম সচিব জনেন্দ্রনাথ সরকার, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান, সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুল মালেক, সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান, অ্যারোনেস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল আলম, পরিচালক লুৎফুল্লাহ মাজেদ, কমিউনিকেশন-নেভিগেশন অ্যান্ড সার্ভিল্যান্স-এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক আফরোজা নাসরিন সুলতানা এবং সাবেক প্রকল্প পরিচালক (পরিকল্পনা) একেএম মনজুর আহমেদ পরস্পর যোগসাজশে প্রতারণা, জালিয়াতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বিগত ১৫ বছরে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজের নামে হাজার হাজার কোটি লুটপাট ও আত্মসাৎ করেছেন।

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয় গ্রেফতার
স্বামীর দুর্নীতির টাকায় স্ত্রীর বিলাসী জীবন
এটিসি কন্ট্রোলার জাহিদুল ইসলামকে বেবিচকের সম্মাননা
সর্বশেষ খবর
ভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
সংযুক্ত কর্মচারী প‌রিষ‌দের জরু‌রি সভানবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন