রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সরকারি সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ঢাকার বাসগুলো একটি সাধারণ ব্যবস্থাপনায় চালানোর জন্য বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প নেয় সংস্থাটি। প্রথম চেষ্টায় সফল হতে না পারলেও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর নতুন করে কার্যক্রম শুরু করে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি। এবার সরকার থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় সীমিত রুট ধরে একটি কোম্পানির আওতায় চলবে ঢাকার সব বাস। এদিকে, সরকারকে উপেক্ষা করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনার দিকে হাঁটছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তারাও অনেকটা রুট রেশনালাইজেশন পদ্ধতি অনুসরণ করে কাউন্টারকেন্দ্রিক বাস চলাচল ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে।
গত ১১ নভেম্বর বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির ২৯তম সভা থেকে বলা হয়, বাধ্যতামূলকভাবে ঢাকার সব বাস কোম্পানি বিলুপ্ত করে একক কোম্পানির আওতায় আনা হবে। এজন্য কমিটি বিজনেস মডেল এবং বাসগুলো কীভাবে চলবে সেই বিষয়ে রূপরেখা তৈরি করা হবে। ঢাকাজুড়ে ৯টি ভিন্ন রঙের বাস ৪২-৪৫টি রুটে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে চলবে। বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ৩৮৮টি রুট রয়েছে রাজধানীতে।
ডিটিসিএ থেকে জানানো হয়, পুরো নভেম্বরজুড়ে রুট রেশনালাইজেশনে যুক্ত হবার জন্য বাস কোম্পানিগুলো থেকে আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে চলাচলের উপযোগী বাসগুলো নেওয়া হবে। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার একাংশে ‘ঢাকা নগর পরিবহন’ নামে একটি কোম্পানির আওতায় বাস চলাচল শুরুর প্রস্তুতি চলছে। এছাড়া যাত্রীসেবার মান নিশ্চিত করতে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা, কাউন্টার, যাত্রী ছাউনি এবং সুনির্দিষ্ট একটি ব্যবস্থাপনা টিম গঠন করা হয়েছে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর শুরুতে নতুন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সরকারকে সহায়তার আশ্বাস দিলেও সেখান থেকে সরে এসেছে। এখন তারা তোড়জোড় করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাস চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামীকাল ৬ ফেব্রুয়ারি তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে যাচ্ছে।
মালিক সমিতি থেকে জানানো হয়, বর্তমান যেসব রুট ধরে ঢাকায় বাস ঢোকে সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে চারটি অংশে কাউন্টার পদ্ধতিতে বাস চালানো হবে। এর মধ্যে গাজীপুর-আব্দুল্লাহপুর থেকে আসা বাস; মানিকগঞ্জ-ধামরাই-সাভার হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করা বাস; বসিলা-মোহাম্মদপুর থেকে আসা বাস ও মিরপুর থেকে আসা বাস—এই চার অংশের বাসগুলোকে মাসখানেকের মধ্যে কাউন্টার পদ্ধতির মধ্যে আনা হবে। প্রথমে আব্দুল্লাহপুর অংশের বাসগুলো দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করা হবে। এর জন্য একশোটি বাস গোলাপি রঙ করে প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা রাখা হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সাইফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একসঙ্গে সব রুটে শুরু করছি না, কারণ সব বাস বন্ধ করে দিলে রাস্তা খালি হয়ে যাবে। ধারাবাহিকভাবে সব বাসকে আমাদের সিস্টেমের ভেতর নিয়ে আসা হবে। যেগুলো ভালো সেগুলো নেবো। আর যেগুলো খারাপ সেগুলো বসিয়ে দেবো।
রুট রেশনালাইজেশনের বাইরে গিয়ে ভিন্ন ব্যবস্থাপনার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিটিসির সঙ্গে আমাদের সাংঘর্ষিক কিছু না। তাদের বলেছি, আপনারা যদি রুট রেশনালাইজেশন করতে চান সেখানে নতুন গাড়ি আনেন। আমাদের নতুন গাড়ি আনার ব্যবস্থা করে দেন, সহযোগিতা করেন। আমরা সেখানে ভালো চালক দেবো। আপনাদের সঙ্গে সমন্বয় করবো। সেই পরিকল্পনার সঙ্গে আমরা আছি। এখন আমরা শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করছি। আগে আমাদের চালক-স্টাফদের মাঝে শৃঙ্খলা আসুক। তারা যেন আর প্রতিযোগিতা না করে যত্রতত্র লোক না উঠায়। এগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছি।
তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কোনও পরিকল্পনার বিষয়ে ডিটিসিএ অবগত নয় বলে জানিয়েছে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তারা কী করতে যাচ্ছে এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি। এ বিষয়ে আমরা কিছু জানিও না। তারা বলছে, তিনটি রুটে চলবে। রুট তিনটি কী তা আমাদের বলছে না। আমরা চিঠি দিয়েছি, তার কোনও রিপ্লাই আসে নাই। কোথায় কোথায় কাউন্টার দিচ্ছে সে বিষয়েও জানাচ্ছে না। জানালে অন্তত আমরা গিয়ে পরামর্শ দিতে পারতাম।
মালিক সমিতি কেন সমন্বয় করছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আর ২৬০০ বাস চালাতে দেবো না। এগুলোর মধ্যে ফিটনেসসহ অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করবো। এগুলো তো সময়সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু তারা যেমন আছে ওভাবেই চালাতে চায়। কোনও সময় দেবে না। তারা যে কী চায়, সেটাই বলছে না।
২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে বাস রুট রেশনালাইজেশন চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে ধ্রুব আলম বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। মাঝে একটা রিভিউ মিটিং আছে, তারপর দেখছি কী হয়।
এদিকে, বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির বা ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কারোর উদ্যোগই টেকসই নয় বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, স্থায়ী সমাধানে না গিয়ে বিষয়টি জটিলভাবে দেখছে উভয় পক্ষ। এভাবে পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।
যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকার বাস ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে সরকারের উচিত নিজের আওতায় একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য প্রয়োজন অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া। এই টাকায় ঢাকার যত বাস আছে, সব কিনে নিয়ে ভালোগুলো রেখে বাকিগুলো ভেঙে ফেলা। এবং কোম্পানিতে দক্ষ জনবল নিয়োগ করা। ঢাকায় ২০ শতাংশ যাত্রী বহনের জন্য যদি ৩০ হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটি মেট্রোরেলের লাইন তৈরি করতে পারে, তাহলে বাকি যাত্রীদের সুবিধার্থে ৪ হাজার কোটি টাকা বেশি নয়।
তিনি বলেন, সরকার কোম্পানিটাকে একটি লাভবান ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে পারলে পরিবহন ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। ঢাকার মধ্যে গুলশান ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় কিন্তু এ ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যথায় যে পদ্ধতিতে ডিটিসিএ এবং মালিক সমিতি যে পরিকল্পনা করছে তা এতটা সহজ হবে না।