সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা রিমান্ড শুনানিতে আদালতে বলেছেন, নির্বাচন হয়ে গেলে কমিশনারের কোনও কিছু করার থাকে না। নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে, কিন্তু সেটার জন্য নির্বাচন কমিশনারের কোনও দোষ নেই।
সোমবার (২৩ জুন) বিকালে শুনানি শেষে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে ৪ দিনের রিমান্ড শুনানিতে বিচারকের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
এদিন বিকাল ৩টার কিছু পরে কেএম নূরুল হুদাকে আদালতের হাজতখানায় হাজির রাখা হয়। পেছনে হ্যান্ডকাপ, মাথায় হেলমেট ও গায়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে ১ ঘণ্টা পর তাকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। পরে হেলমেট ও জ্যাকেট খুলে হ্যান্ডকাপ পরা অবস্থায় কাঠগড়ার দাঁড়ান। এ সময় আইনজীবীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেন তিনি। পরে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা কথা বলতে বাধা দেওয়ায় কাঠগড়ার মাঝামাঝি অংশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ান তিনি। এরপর বিচারক আসেন। প্রথমে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এক সাবেক এমপির মামলার শুনানির আহ্বান করে সাধারণ নিবন্ধন শাখার কর্মকর্তা। পরে শেরে বাংলা নগর থানায় প্রহসনের অভিযোগে করা মামলায় তার ১০ দিনের রিমান্ড শুনানি শুরু হয়।
শুনানিতে রাষ্ট্র পক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিজম তৈরি করার জন্য প্রধান ভূমিকা রেখেছেন নূরুল হুদা। তিনি জনতার হাতে কট। জনগণ ওনাকে রাস্তায় পেয়ে ধরে ফেলেছেন। কারণ হলো, এরা জনগণের ভোটের অধিকার, মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। জনগণের অধিকার হরণ করায় জনগণই তাকে ধরে, পরে উত্তরা এলাকায় পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এরা যদি মানুষের পক্ষে থাকতো, তাহলে হাসিনা এত বড় ফ্যাসিস্ট হতে পারতো না। সে ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিল। রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ্বস্ত করে ভোটে এনেছে। কিন্তু সে জনগণ ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। নির্বাচন কমিশন সারা দেশের সব ডিসিদের নির্দেশ দিয়েছে আগের রাতে সব ভোট সম্পন্ন করার জন্য। তাকে বলা হয়, নিশি রাতের নির্বাচন কমিশনার। সে এরকম নির্বাচন করে, তার আত্মীয়, পরিবারের কাছে কীভাবে মুখ দেখাবে? সে জাতির সঙ্গে এত বড় প্রতারণা করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সে শাসক দলের সঙ্গে সহযোগিতা করে একতরফা নির্বাচন করেছে। সরকারের অন্যান্য যন্ত্র যারা ভোট চুরির সহযোগিতা করেছে, তাদের সঙ্গে সে অপরাধ করেছে। অবৈধ টাকার সাহায্যে সে এ কাজ করেছে। এর মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা লুট করেছে। এছাড়া নির্বাচনের নামে প্রহসনের সঙ্গে আরও যে কয়জন আছে, তাদেরও ধরা হবে। এদেশে যেন আর ফ্যাসিস্ট জম্ম না নেয়, নির্বাচন কমিশনার যেন এ মামলা থেকে শিক্ষা নেয়। সে জন্য তাদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।‘
আসামি পক্ষের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সজীব জামিন শুনানি করেন। তিনি বলেন, ‘রিমান্ড কী কারণে হবে, কেন হবে? সে বিষয়গুলো এখানে আসেনি। মামলার ধারাগুলো দেখার জন্য বলবো। আজ যে ধারায় এ মামলা হয়েছে, সবগুলোই জামিনযোগ্য ধারার। ওনারা জামিনযোগ্য ধারায় মামলা দিয়েছেন, আবার রিমান্ড চাচ্ছেন। এ মামলার এজাহার ত্রুটিপূর্ণ। এ মামলার আইনগতভাবে চলার সুযোগ নেই।’
এ সময় রিমান্ড শুনানিতে বিচারক নূরুল হুদার কাছে জানতে চান, আপনি মনে করেন কিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর আপনার শপথ ভঙ্গ করেছেন? তখন নূরুল হুদা বলেন, ‘না, আমি মনে করি না।’
তখন বিচারক বলেন, আপনার নির্বাচনে সবাই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন কিনা? তখন নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ৫টা লোক নিয়ে গঠিত। আর এ নির্বাচনের জন্য আরও ১৫ লাখ লোক নিয়োজিত থাকে। রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিশ, আর্মি সবাই থাকে। তাদের সবার ওপর নির্বাচনের দায়িত্ব থাকে। কিন্তু ঢাকায় বসে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্বাচনে কী হচ্ছে, সবটা জানার সুযোগ নেই।’
এ সময় বিচারক বলেন, ‘যারা ভোট কারচুপি করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন? তখন নূরুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন হয়ে গেলে নির্বাচন কমিশনের হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। এরপর নির্বাচনের বিষয়টি হাইকোর্ট দেখবে। কোথাও কোনও সমস্যা হলে হাইকোর্ট মামলায় লড়বে।’
এরপর আদালত জানতে চান, নির্বাচনের পর থেকে নির্বাচনি কর্মকর্তারা আপনার অধীনে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে আপনি ব্যবস্থা নিয়েছেন? সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের যে হুঙ্কার মুভমেন্ট ছিল, আপনি তা দেখেছেন কিনা? এ বিষয়ে নূরুল হুদা আদালতে বলেন, ‘এ বিষয়গুলো আমার জানা নেই।’ এরপর তিনি প্রসিকিউশনের এক কথার জবাবে বলেন,‘ডিসি, এসপিকে টাকা দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত করার যে কথা বলা হয়েছে, এ ধরনের কিছুই হয়নি। আর টাকা লেনদেনের এমন কোনও অভিযোগ ছিল না নির্বাচন কমিশনে। এজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নির্বাচন হয়ে গেলে কমিশনারের কোনও কিছু করার থাকে না। নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে, কিন্তু সেটার জন্য নির্বাচন কমিশনারের কোনও দোষ নেই।’
শুনানি শেষে আদালত আসামির ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।