X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘রহস্যজনক’ নিখোঁজের মামলার তদন্তেও রহস্য!

আমানুর রহমান রনি
১২ মে ২০১৬, ১২:৫৭আপডেট : ১২ মে ২০১৬, ১৩:০৭

সালাহউদ্দিন-আবু বকর-জোহা গত কয়েক বছরে সাধারণ থেকে শুরু করে বিশিষ্ট বেশ কিছু মানুষ ‘রহস্যজনকভাবে’ নিখোঁজ হওয়ার পর ফিরে এসেছেন বা তাদের সন্ধান মিলেছে। কিন্তু এসব ঘটনায় থানায় দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা তদন্তে কোনও অগ্রগতি নেই। কোনও মামলারই ‘রহস্য’ উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে পুলিশে অনীহা। মামলার ভবিষ্যৎও অজানা।
দেখা গেছে, নিখোঁজ ব্যক্তিরা ফিরে আসায় বা সন্ধান পাওয়ায় স্বজনরাও এসব মামলা নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বরং ভয়ে তারা নিখোঁজের ঘটনা ভুলে যেতে চাচ্ছেন। তাছাড়া নিখোঁজের পর ফিরে আসা ব্যক্তিরা কখনও গণমাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি। আতঙ্কিত মানুষরা ফিরে আসার পরের জীবনটাকে নতুন জীবন মনে করে আড়ালে চলে গেছেন।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তারা জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য রেকর্ডও করা হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই শেষ। এসব রহস্য উদঘাটনে পুলিশের কতটুকু আগ্রহ আছে আছে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
নিখোঁজের পর ফিরে আসা কয়েকটি ঘটনায় দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছে বাংলা ট্রিবিউন। দেখা গেছে, একটি ঘটনারও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি সংশিষ্ট থানা পুলিশ। এসব জিডি ও মামলার ভবিষ্যৎ কী হবে তাও তাদের অজানা।
১৬ দিন একটি ঘরে চোখ-হাত বেঁধে আটকে রাখা হয়েছিল কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর ভাইয়ের বন্ধু মিজানুর রহমান সোহাগকে। গত ১২ এপ্রিল তিনি বাড়ি ফিরেছেন। পরিবারের অভিযোগ, গত ২৭ মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়। এই ঘটনায় তার বাবা নুরুল ইসলাম ৩০ মার্চ বুড়িচং থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। তবে তদন্তে এ বিষয়ে বুড়িচং থানার পুলিশ এখনও কিছুই পায়নি।

সোহাগ কীভাবে অপহৃত হয়েছিলেন? অপহরণের সঙ্গে কারা জড়িত? তাদের শনাক্ত করা গেছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে বুড়িচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উত্তম কুমরা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘না, না, না।’ ওসি এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি আর কোনও তথ্যও দিতে পারেননি।

আরও পড়ুন: সিদ্ধান্তহীন বিএনপি

এর আগে রহস্যজনক নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর পাওয়া গেছে সাইবার বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহাকে। গত ১৬ মার্চ দিনগত রাত ১টার দিকে রাজধানীর কচুক্ষেত এলাকা থেকে তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহাকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নামিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকেই তিনি নিখোঁজ ছিলেন। পরিবার ও স্বজনদের দাবি তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। ঘটনার এক সপ্তাহ পর ২৩ মার্চ রাতে তাকে বিমানবন্দর এলাকায় ঘোরাফেরা করতে দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাসায় দিয়ে যায়। ঘটনার পর জোহা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে আর কথা বলেননি। তার পরিবারও কথা বলতে রাজি হয়নি।

ঘটনার পর তার স্বজনরা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে প্রথমে কলাবাগান থানায় যান। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ তাদের জানায়, যেহেতু তিনি সর্বশেষ কচুক্ষেত এলাকা থেকে কথা বলেছেন, এজন্য কাফরুল থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে হবে। জোহার চাচা মাহবুবুল আলম জিডি করতে কাফরুল থানায় যান। কাফরুল থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তাকে জানান, এটি ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় পড়েছে। সেখান থেকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, ঘটনাস্থল ভাষানটেক থানায় পড়েছে। পরে ওই থানায়ও যোগাযোগ করেন মাহবুবুল আলম। সেখান থেকেও বলা হয় ঘটনাস্থল তাদের এলাকায় পড়েনি।

শুরুতে তাকে উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা দেয়নি বলে অভিযোগ এলেও থানা পুলিশ শেষ পর্যন্ত ওই ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি নিতে রাজি হয়। অবশ্য স্বজনরা ‘বিশেষ’ একটি ফোন পেয়ে আর জিডি করেননি।

এ বছরের ২ জানুয়ারি শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবীশ চিকিৎসক শামীম খান তপু অপহৃত হন। ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল মিন্টো রোড থেকে তাকে উদ্ধার করেছিল।

তপুকে অপহরণের পর চিকিৎসকরা আন্দোলনের হুমকি দেয়। আল্টিমেটাম দেয়। এর ৩০ ঘণ্টা পরই তিনি ফিরে আসেন। শেরে বাংলা নগর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। তপুকে কারা অপহরণ করেছিল, তা জানা গেছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে শেরে বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিজি বিশ্বাস বলেন, ‘তপুর সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।’

আরও পড়ুন: সাইবার নিরাপত্তার দায় এড়াতে ব্যাংকে ব্যাংকে সুইফটের চিঠি

২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার সময় রহস্যজনকভাবে অপহৃত হন বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক। অপরহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর তিনি ফিরে আসেন। গত দুই বছরেও অপহরণের রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি বর্তমানে ফতুল্লা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বর্তমানে প্রশিক্ষণে থাকায় তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামাল উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বর্তমানে এ বিষয়ে কোনও লেটেস্ট খবর নেই। তদন্ত কর্মকর্তা ট্রেনিংয়ে রয়েছেন। উনি এলে হয়তো কাগজপত্র দেখে বলতে পারবো। তবে উল্লেখযোগ্য কোনও কিছু নেই।’

২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ছেলেকে বিএএফ শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পৌঁছে দিয়ে নিজের গাড়িতে বাসায় ফিরছিলেন ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার আবুল হাসানাত পলিন। স্কুলগেট থেকে গাড়িটি সামনে যেতেই একটি মাইক্রোবাস পলিনের গতিরোধ করে। দুর্বৃত্তরা পলিনকে টেনেহিঁচড়ে নিজের গাড়ি থেকে নামিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। দুই মাস ১০ দিন নিখোঁজের পর রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় তাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় রেখে যায় অপহরণকারীরা। এই ঘটনায় দায়ের করা অভিযোগের তদন্তের কোনও অগ্রগতি নেই। তার জবানবন্দি রেকর্ড করেছে আদালত। এ বিষয়ে পলিন জানান, ‘যা বলার আদালতে বলেছি। এর বাইরে কিছু বলার নেই।’

২০১৪ সালে সুনামগঞ্জ থেকে অপহরণের সাড়ে তিন মাস পর টঙ্গীতে পাওয়া যায় বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার সহসভাপতি মুজিবুর রহমানকে। সেই রহস্য আজও অজানা।

২০১৫ সালের ১০ মার্চ গভীর রাতে রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর সড়কে ৪৯/বি নম্বর বাড়ির ২/বি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে র‌্যাব ও আইনশৃংখলা বাহিনীর পরিচয়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে তুলে নিয়ে যায় বলে পরিবার ও তার দল বিএনপি অভিযোগ করে। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর গত ১১ মে মেঘালয়ের শিলংয়ে সালাহউদ্দিনের সন্ধান মেলে। তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের দায়ে একটি মামলা করে পুলিশ। দীর্ঘদিন তাকে শিলংয়ের সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ২০ মে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নেগ্রিমস হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেওয়ার পর আদালতে হাজির করা হলে দুই সপ্তাহের পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে শর্ত সাপেক্ষে জামিনে মুক্তি পান সালাহউদ্দিন। এখন তিনি সেখানেই আছেন। এই ঘটনায় ১১ মার্চ রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ। ১২ মার্চ তিনি উচ্চ আদালতেও একটি আবেদন করেন। আদালত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সালাহউদ্দিনকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশনা দেন। ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে সালাহউদ্দিন নিজেই আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার রহস্য তাই আর বের হয়নি। এখনও এর তদন্ত চলছে। পুলিশের দাবি, এর রহস্য ভেদ করতে হলে সালাহউদ্দিন আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান জিয়া খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এর রহস্য উদঘাটন করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। তারা সেটা করতে পারলে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসবে।’

আরও পড়ুন: হিড়িক পড়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রার্থীহীনতার

/এআরআর/এজে

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ম্যারাডোনার সংস্পর্শ পাওয়া বাংলাদেশ দলের জুয়েল কেন ‘উধাও’
ম্যারাডোনার সংস্পর্শ পাওয়া বাংলাদেশ দলের জুয়েল কেন ‘উধাও’
আ.লীগের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
আ.লীগের হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাবে বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
খুলনায় বজ্রসহ বৃষ্টি
খুলনায় বজ্রসহ বৃষ্টি
কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে সারা দেশে
কালবৈশাখী বয়ে যেতে পারে সারা দেশে
সর্বাধিক পঠিত
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো