বাংলাদেশে কেবল তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা, মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে বছরে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয় বলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী তামাক খাত থেকে বাংলাদেশের বছরে আয় মাত্র ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এই হিসাবে বছরে নিট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০০৪ সালের জরিপ মতে, প্রতি ৬ সেকেন্ডে একজন করে প্রতিবছর ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয় মৃত্যুবরণ করে। এই হিসাবে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতিবছর তামাকের কারণে মারা যাবে ১ কোটি মানুষ, যার ৭০ লাখই বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসী।
এদিকে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে ক্যান্সারের প্রকোপ বিষয়ে ১১ হাজার ক্যান্সার আক্রান্ত নারী ও পুরুষের ওপর গবেষণা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর বেশির ভাগই ফুসফুস সংক্রমণে ভোগেন। এ ধরনের রোগীর মধ্যে শতকরা ২৮ ভাগই পুরুষ।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০০৯-এর জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটিরও বেশি। এর মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা ২ কোটি ১৯ লাখ। ধুমপান ও তামাকের কারণে নানারকম ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, এজমাসহ রোগগুলোতে মানুষের মৃত্যুর হার বেশি। গ্যাটস-এর ২০১৩ সালের জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী বিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েদের ৬.৯ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে। শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ ফুসফুসের ক্যান্সার, ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মুখের ক্যান্সারসহ মোট ক্যান্সারের অর্ধেকের জন্য দায়ী তামাক। বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায় ৭ হাজারের বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যার মধ্যে ৬৯টি ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলোজি বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি চার জনে একজন ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী। ধূমপানজনিত ক্যান্সারে যারা মারা যান, তাদের মধ্যে ২২ ভাগই হলো ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী। আবার মুখ ও গলার ক্যান্সারের আক্রান্তদের শতকরা ৯০ ভাগই ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাকে অভ্যস্ত।’ পান-সুপারির সঙ্গে জর্দাসহ বিভিন্ন উপায়ে সরাসরি তামাক গ্রহণকে ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন হিসেবে অভিহিত করে তিনি জানান, ‘ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের কারণে লিভার, সার্ভিক্যাল, কিডনি, মূত্রথলি এবং পাকস্থলীর ক্যান্সারও হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সরকার ২০০৩ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাক্যো কন্ট্রোলে (এফসিটিসি) স্বাক্ষর করে, ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করে। ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোবাক্যো কন্ট্রোল জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি।
এদিকে, সোমবার (২৮ মে) এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানিয়েছেন, তামাকের ব্যাপক ক্ষতি মোকাবিলায় সরকার সব ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের ওপর স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ আরোপ করেছে। আর সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অসংক্রামক রোগ ও তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর ২০১৭-২০২১ সাল পর্যন্ত অসংক্রামক রোগ সংক্রান্ত অপারেশনাল প্ল্যানে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য অর্থ বরাদ্দ রেখেছে পর্যাপ্ত হারে।’
তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞার মতে, তামাক ব্যবহারজনিত ব্যাপক ও মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি এসডিজির তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা-সুস্বাস্থ্য অর্জনের অন্যতম অন্তরায়। প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মানুষের প্রত্যাশিত সময়ের আগে তামাকজনিত রোগের কারণে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে তার পরিবার ও রাষ্ট্র তার আয় থেকে বঞ্চিত হয়। একে বলা হয় আয়-ক্ষতি।’ তামাকজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের কারণে বাংলাদেশে বছরে ৬৫২ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন ডলার আয়-ক্ষতি হয় বলেও তিনি জানান।
/এমএনএইচ/