জঙ্গি রাশেদ ওরফে র্যাশ ছিল মেধাবী শিক্ষার্থী। সে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার আসল নাম আসলামুল ইসলাম। ২০১৪ সালে তখন রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকাবস্থায় অনলাইনে জঙ্গিবাদ-বিষয়ক ভিডিও দেখতে দেখতেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। এরপর ২০১৫ সালের শেষের দিকে কথিত হিজরতের নামে ঘর ছাড়ে। নব্য জেএমবির অন্যতম প্রধান তামিম চৌধুরীর আস্থাভাজন হয়ে ওঠে ২৩ বছরের এই তরুণ। গত বছরের আলোচিত গুলশান হামলার পরিকল্পনা করাসহ এই ঘটনা সে বাস্তবায়ন করে। অস্ত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে, অন্যদের সঙ্গে হলি আর্টিজান রেকি করা, পাঁচ হামলাকারীকে দেখভাল করাসহ নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল রাশেদ। আর নব্য জেএমবিতে তার দায়িত্ব ছিল মিডিয়া ও হিজরতকারীদের ট্রেইনিং ক্যাম্পের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করা। শুক্রবার ভোরে নাটোরের সিংড়া থেকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ও ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
নাটোর থেকে সন্ধ্যায় আসলামুল ইসলাম ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশকে ঢাকার মিন্টো রোডের সিটিটিসি কার্যালয়ে আনা হয়েছে। শনিবার আদালতে সোপর্দ করে গুলশান হামলা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড আবেদন করা হবে তার।
সিটিটিসির উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘গুলশান হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন হলো এই রাশেদ। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার কাছ থেকে অনেক তথ্য উদ্ধার করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাল ক্রাইম ইউনিট সূত্র জানায়, নওগাঁর মান্দা এলাকার আব্দুস সালামের ছেলে রাশেদ উচ্চমাধ্যমিক পড়া অবস্থাতেই প্রথমে অনলাইনে র্যাডিক্যাল হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে নব্য জেএমবির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। ঢাকায় আসার পর তামিম চৌধুরী ও মারজান তার পরীক্ষা নেয়। আকিদা ও মানহাজ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্নে রাশেদের উত্তরে খুশি হয় তারা। ফলে হিজরতকারীদের প্রাথমিক যে ট্রেনিং দেওয়া হয়, রাশেদকে সেই ট্রেনিং নিতে হয়নি। এরপর থেকে তামিম-মারজানদের সঙ্গেই থাকতো সে।
রাশেদ সম্পর্কে সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সে ধীরে ধীরে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠে। তামিম চৌধুরী তাকে নব্য জেএমবির মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন ও হিজরতকারীদের দেখভালের দায়িত্ব দেয়। নব্য জেএমবির নতুন সদস্যদের প্রাথমিক ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করা, তাদের বাসা ভাড়া, খরচ ও অন্যান্য বিষয়ে দেখভাল করতো এই রাশেদ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদ জানিয়েছে, হিজরতকারীদের ঢাকায় আসার পর তাদের রিসিভ করে ট্রেইনিং ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া ছিল তার মূল কাজ। এর বাইরে তার দায়িত্ব ছিল যারা হিজরত করতে চায়, তাদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সদস্য ছদ্মবেশে তাদের দলে ঢুকছে কিনা, তা যাচাই করতো সে। রাশেদ অনেকটা নব্য জেএমবির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতো বলেও এই কর্মকর্তা জানান।
গুলশান হামলার পর রাশেদের নাম আসে প্রথম তানভীর কাদেরীর ছেলের আদালতে দেওয়া জবানবন্দি থেকে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর মহানগর হাকিম আহসান হাবীবের কাছে দেওয়া এক জবানবন্দি সে বলে, ‘...একদিন রাশেদ আর চকলেট আংকেল এসে পল্লবীর বাসার পাশাপাশি অন্য এক জায়গায় বাসা নিতে বলে....।’ কাউন্টার টেরোরিজম কর্মকর্তারা বলছিলেন, রাশেদ সবসময় তামিম চৌধুরীর সঙ্গে থাকতো। তামিম চৌধুরীর ম্যাসেঞ্জার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতো সে। মারজান ও চকলেটের পাশাপাশি রাশেদও ছিল তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানান, ‘রাশেদ ২০১৩ সালে রাজশাহীর নওহাটা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। এরপর রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হয়। ২০১৪ সালে সে রাজশাহীর মাইকেল বেরিও নামে একটি কোচিং সেন্টারে আইইএলটিএস শেখার জন্য ভর্তি হয়। এ সময় সে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা জসিমউদ্দিন রাহমানী ও আল কায়েদা নেতা আনওয়ার আল আওলাকির ভিডিও বক্ততা শুনতো। এভাবেই সে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়লে রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়ে পড়ুয়া ফরহাদ নামে এক বড় ভাইয়ের কাছে জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছার কথা বলে। ফরহাদ নিজেও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত ছিল। পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী নব্য জেএমবি নেতা শরীফুল ইসলাম খালেদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয় ফরহাদ। খালিদের হাতে হাত রেখে বাইয়্যাত গ্রহণ করে রাশেদ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদ জানায়, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহীতে তামিম চৌধুরী ও আব্দুস সামাদ ওরফে মামু ওরফে আরিফের সঙ্গে তার দেখা হয়। এরপর তামিম চৌধুরীর কথামতো সে রাজশাহী থেকে ঢাকায় চলে আসে। অবশ্য এর আগেই সে কথিত হিজরতে নামে ঘর ছেড়ে খালিদের সঙ্গে থাকতো।
ট্রেনিং ক্যাম্পের কো-অর্ডিনেটর ছিল রাশেদ
সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, রাশেদের দায়িত্ব ছিল ট্রেনিং ক্যাম্প কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। হিজরত করার পর ৫-৬ জনকে নিয়ে একেকটি ট্রেনিং ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। সেসব ট্রেনিং ক্যাম্পে তিন জন প্রশিক্ষক থাকতো। রাশেদ তিন প্রশিক্ষকের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রশিক্ষণগুলোর আয়োজন করতো। এসব প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অস্ত্র চালনার প্রাথমিক প্রশিক্ষণসহ আকিদা ও মানহাজ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
কাউন্টার টেরোরিজমের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘রাশেদ খুব চৌকস। সে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়েও অনেক এক্সপার্ট। সংগঠনের কর্মীদের সে সিক্রেট নানারকম অ্যাপসের আইডি খুলে দেওয়ার কাজও করতো।
গুলশান হামলায় রাশেদের সম্পৃক্ততা
পরিকল্পনার পাশাপাশি রাশেদ গুলশান হামায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ অস্ত্র ও গ্রেনেড রিসিভ করার কাজও করেছে। সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও গ্রেনেডের চালানটি ছোট মিজান ও হাদিসুর রহমান সাগর ঢাকার শেওড়াপাড়ার আস্তানায় আনে। শেওড়াপাড়ার বাসায় এই অরে চালানটি রাশেদ, মারজান রিসিভ করে। পরে সেখান থেকে অস্ত্র ও গ্রেনেডের চালানটি বসুন্ধরার বাসায় নিয়ে যায় তারা।’
গুলশান হামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘রাশেদ এই হামলার সঙ্গে নানাভাবে জড়িত। তামিম চৌধুরীসহ মারজান, চকলেট, রাজীব গান্ধীসহ সবার সঙ্গে একসঙ্গে চলাফেরা করতো। গুলশান হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিষয়ে সব ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল রাশেদ। তার সঙ্গে গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ হামলাকারীর সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ ছিল। পাঁচ হামলাকারীর প্রশিক্ষণের আয়োজনও করেছিল এই রাশেদ।
আরও পড়ুন: জঙ্গি রাশেদ ক্রসফায়ারে মারা গেছে ধারণা ছিল এলাকাবাসীর!
/এমএনএইচ/