X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

বধ্যভূমির মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি

শাহেদ শফিক
১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:১১আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৫:৫৬

নকশাপ্রণেতা: স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও ও স্থপতি জামি-আল-শফী

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের মূল যে পরিকল্পনা ছিল, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি এতদিনেও। এ কারণে তরুণ প্রজন্মের কাছে এই স্মৃতিসৌধের যে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কথা, তা সফল হচ্ছে না। এরপরও যুগ যুগ ধরে এই স্মৃতিসৌধ বাঙালি জাতিকে অনুপ্রেরণা যোগাবে। এমনটাই মনে করছেন সৌধটির নকশা প্রণয়নকারী স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।

১৯৭১ সালে এই স্থানটি ছিল একটি ইটভাটা। যেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এদেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদল, আল-শামস ঘাতকরা বাঙালি শিক্ষক, লেখক, গবেষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।  মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ ও সেই ইতিহাসকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

রায়েরবাজার স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ১৯৯৬ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৯৯ সালে। সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস যৌথভাবে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রণয়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। এতে ২২টি নকশা জমা পড়ে। এর মধ্য থেকে স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও স্থপতি জামি-আল-শফী প্রণীত নকশাটি নির্বাচন করা হয়। গণপূর্ত বিভাগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব লাভ করে। ১৯৯৬ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হয় ১৯৯৯ সালে।

তবে যে চেতনায় এই বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে তা এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে মনে করছেন সৌধের নকশা প্রণেতা ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সৌধের নকশার সঙ্গে মিউজিক সিস্টেম রাখা হয়েছে। এর জলাশয়ের পূর্ব দেয়ালের ভেতর থেকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গানের যন্ত্রসংগীত প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা আছে, যা দেশে প্রথমবারের মতো এই স্মৃতিসৌধে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে এতে আগত দর্শনার্থীরা সৌধের মূলবার্তার সঙ্গে গানের সূর ও কথায় সেই অনুভূতি অনুভব করতে পারবেন। কিন্তু সেই যন্ত্রসংগীত এখন বাজানো হচ্ছে না। যে কারণে তরুণ প্রজন্ম সৌধের প্রকৃত ম্যাসেজ পাচ্ছে না।’

তাছাড়া, স্মৃতিসৌধের লাইটিং ব্যবস্থা নিয়েও এই স্থপতি হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সৌধের লাইটিং এমনভাবে করা হয়েছে, যা দূর থেকে অন্ধকার রাতে শুধু দেয়ালটি দেখা যাবে। কিন্তু এখন সেই লাইটিং করা হচ্ছে না। যে কারণে অন্ধকার রাতে দূর থেকে সৌধটি দেখা যাচ্ছে না।’

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানান, সৌধটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে দাঁড়ালেই ৭১ এর সেই করুণ চিত্রটি স্মরণ করিয়ে দেয়। দূর থেকে সৌধের চন্দ্রাকৃতির দেয়ালটির যতো কাছে যাওয়া যাবে, মনে হবে দু’দিক থেকেই যেন দেয়ালটি আপনাকে ঘিরে ধরছে। সেখানে দাঁড়ালেই হৃদয়বান মানুষকে নিয়ে যাবে সেই ১৪ ডিসেম্বরে।

তিনি আরও জানান, প্রথমে তিন একর জমির ওপর স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরিত্যক্ত ইটখোলার বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে আছে প্রায় ৫৮ ফুট উচু, ৩৮০ ফুট লম্বা ও ৩ ফুট চওড়া ইটের বাঁকা দেয়াল, যার দুই পাশে ওপরের দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙে দেওয়া আছে। বাঁকা দেয়ালটি যেন মাটিকে আগলে রেখে ধীরে ধীরে ওপরে ওঠে আবার মাটিতেই মিশে গেছে। যা বেদনার প্রকাশকে করে আরও গাঢ়। এই দেয়ালের সামনে একটি কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে। এ জলাশয় থেকেই উঠে এসেছে বিশাল আকারের একটি কালো স্তম্ভ। এটি শোকের প্রতীক। যা দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের সেই কালো রাতগুলোতে।

স্মৃতিসৌধটির এই নকশা প্রণয়নকারী আরও বলেন, ‘দূর থেকে সৌধটিকে একটি স্মার্ট কংক্রিটের স্থাপনা মনে হবে। কিন্তু যত কাছে আসা হবে এর ভাঙা দেয়ালগুলো দেখে সেদিনের করুণ চিত্রগুলো সবার সামনে ফুটে উঠবে। এই দেয়াল আরও যতো পুরনো হবে তখন এটা আরও বেশি শোক ও বেদনার বার্তা দেবে। এজন্যই একে প্রতীকীরূপ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।’

এই স্থপতি বলেন, সৌধের দেয়ালে একটি বর্গাকার জানালা রয়েছে। জানালাটি দিয়ে পেছনের খোলা আকাশ দেখা যায়। এটি বার্তা দেয় একখণ্ড মুক্ত আকাশের জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি কিংবা আমাদের বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছেন। এটি দেয়ালের বিশালতাকে কমিয়ে আনে। জানালার ফ্রেমে ভেসে ওঠা আকাশ ও রক্তিম সূর্য নতুন দিনের বার্তা শোনায়।

সৌধের দেয়াল ভাঙা করে নির্মাণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রায়েরবাজারে যখন বাবার হাত ধরে তার ছোট সন্তানটি আসবে, তখন স্মৃতিসৌধের ভাঙা দেয়ালগুলো দেখে সে তার বাবাকে প্রশ্ন করবে, বাবা এটা ভাঙা কেন? এই ভাঙা দেয়ালের কাছে কেন নিয়ে এসেছো? তখন বাবা এর ইতিহাস বলতে তার সন্তানকে বলতে বাধ্য হবেন। সন্তানরা জানতে পারবে পাকিস্তানিদের নৃশংসতার কথা। এই দেয়াল তরুণ প্রজন্মকে বলছে দেখো আমার মতো ভাঙা দেয়ালও পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।

প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে রায়েরবাজার বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধটি। এর প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই দেখা মিলবে একটি বটগাছের। এই বটগাছ কাছের শারীরিক শিক্ষা কলেজ প্রাঙ্গণের আদি বটগাছের প্রতীকরূপ। এই গাছটির নিচেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। পরে স্মৃতিসৌধের আদিরূপ ইটখোলায় নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গটি তুলে ফরিদ উদ্দিন বলেন, এই বটগাছেরই প্রতিনিধি হিসেবে নতুন একটি বটগাছ মূল দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তার সৌন্দর্য নিয়ে গড়ে তুলবে একটি প্রাকৃতিক ছায়া শীতল ছাউনি। যে গাছটি মহাকালের নীরব সাক্ষী হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে। আর বটগাছের মানে হচ্ছে সে অনেক পথচারীকে তার ছায়াতলে আশ্রয় দেয়। আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরাও আমাদের জন্য বটগাছের মতো আশ্রয়দাতা ছিলেন। তার নমুনাস্বরূপ বটগাছটি রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া, স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণচূড়া, পলাশ ও শিমুল গাছ রোপণ করা হয়েছে। এই গাছগুলোর লাল ফুল রক্তের প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা জানান, বটগাছটি ছাড়া সৌধচত্বরে যেসব গাছ লাগানো হয়েছে সেগুলোর পাতা ঝরে ডিসেম্বর মাসে। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পত্রহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো দর্শনার্থীদের শোকানুভূতিকে আরও আবেগময় করে তোলে।

স্মৃতিসৌধের নকশা ও নির্মাণের মূল সার্থকতা তুলে ধরে এই স্থপতি বলেন, ‘ভাঙা বিশালাকার বাঁকা দেয়াল, বদ্ধ জলাশয়, বটগাছ, কালো শোকস্তম্ভ– সব মিলিয়ে এক সুকরুণ নান্দনিক দ্যোতনার সৃষ্টি করে। স্মৃতিসৌধটি যতই পুরনো হতে থাকবে ততই সুদৃঢ়ভাবে মূল বক্তব্য ও চেতনাকে আগামী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারবে।’

শুধু বছরের নির্দিষ্ট একটি সময় স্মৃতিসৌধের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি পুরো বছরই সমানভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান।

 

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
শিশুর ত্বকের যত্নে বাজারে এলো ‘সিওডিল বেবি ক্রিম’
এই গরমে ক্রিকেট খেলা অমানবিক: সাকিব
এই গরমে ক্রিকেট খেলা অমানবিক: সাকিব
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে নৌ ও বিমান বাহিনী
সুন্দরবনের আগুন নেভাতে যোগ দিয়েছে নৌ ও বিমান বাহিনী
মৌসুমের চতুর্থ হ্যাটট্রিকে রেকর্ডের কাছে রোনালদো  
মৌসুমের চতুর্থ হ্যাটট্রিকে রেকর্ডের কাছে রোনালদো  
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি