X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মাস্টার প্ল্যান ভঙ্গ করে হাতিরঝিলে দোকান

শাহেদ শফিক
২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:২৪আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:৩৬

 



উন্মুক্ত জায়গাজুড়ে বসেছে খাবারের দোকান রাজধানীর হাতিরঝিলের মাস্টার প্ল্যান ভঙ্গ করে ২৯টি খাবার দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে হাতিরঝিলের স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। কমছে উন্মুক্ত স্থান। পাশাপাশি ওই সব দোকানে খেতে আসা মানুষের অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে এ পথে চলাচলকারী যানবাহনের গতিও কমছে। বাড়ছে দুর্ঘটনা। এসব দোকানের খাবারের মান ও দাম নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্টার প্ল্যানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এ ধরনের দোকান ঝিলের ন্যাচারাল সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।

এ বিষয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মজিবুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাতিরঝিলের মাস্টার প্ল্যানে কোনও খাবার হোটেল বা দোকান ছিল না। তবে ২০১৩ সালের দিকে যখন দেখা গেল মানুষের সমাগম অনেক বেশি, তখন তাদের প্রয়োজনে কিছু  ফুড কোর্টের কথা বলা হয়েছে। তবে তা সংখ্যায় ৩-৪টির বেশি নয়। কিন্তু তাও  ‍যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ, ঝিলের এম্ফি থিয়েটারে (উন্মুক্ত মঞ্চ) খাবার হোটেলের ব্যবস্থা থাকছে। ঝিলের উন্মুক্ত স্থানগুলোতে গণহারে দোকান অগ্রহণযোগ্য। এটা মূল পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’

হাতিরঝিলে খাবারের দোকান সরেজমিনে দেখা গেছে, বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা হাতিরঝিলের উন্মুক্ত স্থান দখল করে পিকআপ ভ্যানে খাবারের দোকান পরিচালনা করছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও হাতিরঝিল প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেওয়া সীমানাও মানছে না তারা। দোকানগুলো নির্ধারিত এলাকার বাইরেও বসছে। কেউ কেউ ফুটপাত কেটে খাবারের গাড়ি রাখার জন্য স্থায়ীভাবে জায়গাও করে নিয়েছে। আবার অনেকেই ত্রিপল-ছাতা আর চেয়ার-টেবিল দিয়ে বরাদ্দের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি জায়গা দখল করে রেখেছে। এমনকি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যেসব স্থানে ঘাস ও ফুলের চারা রোপণ করেছে, সেসব জায়গাও দখল করে রাখা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ বলা হলেও বেশির ভাগ দোকান মালিক স্থাপনা নির্মাণ করে দোকানগুলোর স্থায়ী রূপ দিয়েছেন। আবার কয়েক দোকানি বিশাল এলাকা লোহার গ্রিল দিয়ে দখল করে ব্যবসা করছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলার কথা থাকলেও বেশ কিছু দোকানে দেখা গেছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। দোকানগুলোতে খাবারের দাম ও মান নিয়ে খেতে আসা সাধারণ মানুষের অভিযোগের শেষ নেই।

পিকআপে খাবারের দোকান বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, ‘হাতিরঝিল হোটেল রেস্তোরাঁর  জন্য করা হয়নি। এটি দিন দিন কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে। হাতিরঝিল মূলত তৈরি করা হয়েছে ঢাকার পানি ধারণ করার জন্য। হাতিরঝিলের যে চরিত্র ছিল, তা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। যদি খাবার হোটেল বা রেস্তোরাঁ করতেই হয়, তাহলে ঢাকার অন্যান্য স্থানে করা হোক, কিন্তু হাতিরঝিলে নয়।’

প্রকল্পসূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে ২৯টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এসব দোকান হবে ভ্রাম্যমাণ। দুপুরের পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত তারা ব্যবসা করতে পারবে। এরপর নিজ ব্যবস্থাপনার পিকআপ ভ্যানে করে চলে যাবে। প্রথম কয়েকদিন এমন চিত্র দেখা গেলেও বর্তমানে কোনও দোকানই ভ্রাম্যমাণ নয়। উপরন্তু, সব দোকান ঝিলের পাড় ঘেঁষে ও উন্মুক্ত স্থান দখল করে, অবকাঠামো নির্মাণ করে পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্প কর্মকর্তার দাবি, মানসম্মত খাবার আর প্রকল্প এলাকা রক্ষণাবেক্ষণে অর্থ জোগাড় করতেই এসব দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ ইজারার শর্ত ভঙ্গ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বরাদ্দের চেয়ে বেশি জায়গা দখল করে বসেছে খাবারের দোকান রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন মন্দিরের সামনের বিশাল এলাকাজুড়ে উন্মুক্ত স্থানে আগে সাধারণ দর্শনার্থীরা বসতেন। এখন সেখানে কোনও উন্মুক্ত স্থান নেই। বিশাল এলাকাজুড়ে বসানো হয়েছে খাবার দোকান। প্রথম দিকে দোকানটি ক্ষুদ্র পরিসরে দেখা গেলেও এখন চিত্র পাল্টে গেছে। দোকানটির ওপরে রয়েছে টিনের চাউনি। চারদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছে।

বনশ্রী থেকে স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে আসা সরকারের একজন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে হাতিরঝিলের মূল উদ্দেশ্য কী? দোকান দিয়ে যদি উন্মুক্ত স্থান দখল করে রাখা হয়, তাহলে মানুষ ঘুরতে এসে বসবে কোথায়।’ তিনি দোকানটির ঘেরাও করা অংশ দেখিয়ে বলেন, ‘আগে এখানের উন্মুক্ত স্থানের ঘাসে শতশত দর্শনার্থী বসতেন। শিশুরা খেলাধুলা করতো। এখন সব দখল হয়ে গেছে। হাতিরঝিলে কি মানুষ ঘুরতে আসবে, না খেতে আসবে?’

গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে প্রায়ই এ ধরনের যানজটের সৃষ্টি হয় জানা গেছে, প্রতিমাসে দোকানপ্রতি  রাজউককে ৭৫ হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে হয়। দোকান মালিকরা এই ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতনভাতার বিষয়টি মাথায় রেখে লাভের চিন্তা করেন। যে কারণে সব খাবারের দাম অতিরিক্ত। প্রতিটি দোকানে একটি শর্মা বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়। বার্গারের দাম নেওয়া হচ্ছে ৯০-১০০ টাকা। খাবার পানির বোতলও বিক্রি হচ্ছে পাঁচ টাকা বেশি দামে। খাবারের মানও উন্নত না। মোহাম্মদপুরের ব্যবসায়ী আবু রাহাত বলেন, ‘খাবারের দাম খুব বেশি।মানও ভালো না।’  

ঝিলের বাড্ডা সংলগ্ন অংশের একটি ফুটওভার ব্রিজের নিচে ‘ইওড’ নামে একটি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দোকান সংলগ্ন সড়কে প্রায়ই মোটরসাইকেল ও মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন যানবাহন পার্কিং করতে দেখা যায়। এতে ওই অংশে প্রায়ই যানজট লেগে থাকে।

জানতে চাইলে দোকানের দায়িত্বে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মাসে যদি একটি দোকানের ভাড়া হয় ৭৫ হাজার টাকা, তাহলে সেই টাকা তো আমাদের তুলতেই হবে। আর দোকানে ক্রেতা আসলে স্বাভাবিকভাবেই তার যানবাহনটি সামনে রাখতে হবে। যারা দোকান বরাদ্দ দিয়েছে, বিষয়টি তাদের ভাবা দরকার।’

ঝিলের ফুটপাত কেটে খাবারের গাড়ি রেখে দোকান বসানো হয়েছে। নামহীন দোকানটির দায়িত্বে থাকা আরিফ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাতিরঝিলের সব দোকানই ভ্রাম্যমাণ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন দোকানের জন্য যদি জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়, খাবারের গাড়ির জন্যও তো জায়গা দিতে হবে। জায়গা না থাকলে আমরা কী করবো?’

রাস্তাজুড়ে গাড়ি পার্কিং

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দোকানের আরেক কর্মচারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ আমাদের জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে। দোকান ভাড়াও অনেক। প্রতিদিন যে বিক্রি হয়, তা দিয়ে খরচ উঠিয়ে নেওয়া কষ্টের । তিনি বলেন, ‘খেতে আসলে মানুষ গাড়ি পার্কিং তো করবেই। এখানে আমাদের কী করার আছে?’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মাস্টার প্ল্যানে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি ছিল না, এমন নয়। হাতিরঝিলে ঘুরতে আসা মানুষের কথা চিন্তা করে আমরা খাবার বিক্রির জন্য ২৯টি দোকানের অনুমতি দিয়েছি। তাদের বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দপ্রাপ্তদের অবশ্যই শর্ত মানতে হবে। যদি কেউ শর্ত না মানে বা নিম্নমানের খাবার বিক্রি করে, আমরা অবশ্যই তাদের দোকান ভেঙে দেবো। এখানে আপসের কিছু নেই। অভিযোগ যেহেতু এসেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।’

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘জার্মানির তৃতীয় বিভাগের ক্লাবের সঙ্গেও বাংলাদেশকে মেলানো যায় না’
‘জার্মানির তৃতীয় বিভাগের ক্লাবের সঙ্গেও বাংলাদেশকে মেলানো যায় না’
তোরণ ও ব্যানার টানিয়ে জরিমানা গুনলেন তিন প্রার্থী
তোরণ ও ব্যানার টানিয়ে জরিমানা গুনলেন তিন প্রার্থী
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ মে, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
আমেরিকা যাচ্ছেন ৩০ ব্যাংকের এমডি
নীরবে মামুনুল হক,  শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
নীরবে মামুনুল হক, শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক