X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

‘জঙ্গিরা ভালো ছেলেদের টার্গেট করে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে’

নুরুজ্জামান লাবু
২০ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:৫৫আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০১৮, ০০:০৯

 

 ‘র‌্যাডিক্যালাইজেশন ও উগ্রবাদ প্রতিরোধ: পরিবার ও সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা ‘আমরা চুপ থাকলে দেশ একদিন পাকিস্তান হয়ে যাবে। আমরা সন্তানকে এত কষ্ট করে মানুষ করি। আমাদের ভালো ছেলেদের টার্গেট করছে ওরা। জঙ্গিরা টার্গেট করে ভালো ছেলেদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। ওই জঙ্গিদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। আমরা চুপচাপ থাকলে তো দেশ একদিন পাকিস্থানের মতো হয়ে যাবে।’ শনিবার  ‘র‌্যাডিক্যালাইজেশন ও উগ্রবাদ প্রতিরোধ: পরিবার ও সমাজের ভূমিকা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া এক তরুণের মা  এসব কথা বলছিলেন।

ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) আয়োজনে দিনব্যাপী এই মতবিনিময় সভায় ১৪টি পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। যাদের মধ্যে গুলশান হামলায় নিহত পাঁচ জঙ্গির পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। মূল আলোচকের ভূমিকায় ছিলেন সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম।

সিটিটিসির উদ্যোগে আয়োজিত এই মতবিনিময় সভার উদ্দেশ্য জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ সন্তানেরা ঘর ছাড়ার আগে তাদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল, তা পরস্পরকে জানানো। একইসঙ্গে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে পরিবারের সদস্যদের করণীয় ও ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আমরা চাই, দেশের বর্তমান বাস্তবতা, ভবিষ্যৎ র‌্যাডিক্যালাইজেশন ও উগ্রবাদ প্রতিরোধ করতে পরিবারের কাছ থেকে র‌্যাডিক্যাল হওয়ার লক্ষণগুলো জানা, র‌্যাডিক্যালদের সামাজিকীকরণ, পারিবারিক মিথস্ক্রিয়ার মাত্রা জানা ও র‌্যাডিক্যালাইজেশন প্রতিরোধে সুপারিশ প্রণয়নসহ ভুক্তভোগী পরিবারের নিয়ে একটি সামাজিক সচেতনতা তৈরি করা।’
রংপুর মেডিক্যাল থেকে এমবিবিএস পাস করা চিকিৎসক ওই তরুণের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমরা সেই জেনারেশনের মা-বাবা সেই জেনারেশন একটা ভূমিকম্পের মতো একটা চেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছি। এমবিবিএস সেকেন্ড ইয়ার শেষ করার পর ওর মধ্যে একটু চেঞ্জ দেখলাম। আমি আগে হিজাব পরতাম না। ও একদিন বললো, আম্মু হিজাব পরো। তাতে কিছু মনে হয়নি। একসময় আইএসের ভিডিওর ছড়াছড়ি ছিল। তা দেখতো। তারপর ও নানা ইসলামিক লেকচার শুনতো। এসবেরই একপর্যায়ে সে ভুল পথে পা বাড়ায়।’
জঙ্গিবাদের ভুল পথে যাওয়া বুঝতে পারা ও বর্তমানে জামিনে থাকা এই তরুণের মা বলেন, ‘ওরা ভুল লেকচার শুনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কি আলেম কম রয়েছে? তাদের লেকচার কেন বেশি বেশি প্রচার করা হয় না? আমাদের বড় বড় আলেমকে শুধু দেখি একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে কথা বলেন।এই যে আমাদের ছেলে-মেয়েরা ভুল মেসেজ পেয়ে প্ররোচিত হচ্ছে,  এই আলেমরা  কি পারেন না সবাই এক হয়ে বলতে যে, এসব ভুল, এই ব্যাখ্যাটা এরকম হবে?’ তিনি বলেন,  ‘আমরা এভাবে কথা বলতে বলতে একটা না একটা ভালো পথ বের হয়েই আসবে। আর যেন কোনও বাবা-মাকে ভুক্তভোগী হতে না হয়।’

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় অংশ নেওয়া রোহান ইমতিয়াজের বাবা ইমতিয়াজ খান বাবুল বলেন, ‘আমার স্ত্রী শিক্ষক। আমি নিজেও শিক্ষক ছিলাম। আমরা মানুষ গড়ার কারিগর। কিন্তু আমার ছেলে কখন ভুল পথে চলে গেছে, বুঝতেই পারিনি। এটা আমার জন্য চরম ব্যর্থতা। বাবা হিসেবে যেগুলো আমার খেয়াল করার কথা ছিল, সেগুলো খেয়াল করতে পারিনি।’

ক্ষমতাসী দলের রাজনীতিতে সক্রিয় সন্তান হারানো এই বাবা জঙ্গিবাদ দমনে নিজের জোরালো ভূমিকা রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করতে আমাদের ভিকটিম পরিবার থেকে একটা সংগঠন করা প্রয়োজন। এই সংগঠন কেন্দ্রীয় হতে পারে। ডিভিশনালি শাখা থাকবে। ধীরে-ধীরে ডিস্ট্রিক্ট পর্যায়ে যাবে। এই সংগঠনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন থাকতে হবে। এটা করতে ফান্ড প্রয়োজন, এ জন্য ব্যবসায়ীদের রাখা যেতে পারে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তো থাকবোই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি থাকতে পারে। একটা ব্যানার নিয়ে আমরা সারা বাংলাদেশে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে পারি। আমরা আমাদের সন্তানদের, যারা গেছে তো গেছেই আর যেন কেউ না যায়, আমরা সেই চেষ্টা করবো।’

গুলশান হামলায় নিহত নিবরাস ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলেটার বিষয়ে যদি আগে বুঝতাম, আমি তাকে সারাজীবন সঙ্গে সঙ্গে রাখতাম।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন কিছু করতে হবে, যেন আর কোনও বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়। আর কোনও বাবা-মাকে যেন এমন হাহাকার করতে না হয়। আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অবশ্যই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারবো। আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হলে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

কারও নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে তা খোঁজ করার আহ্বান জানান নিবরাসের মা। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের নিখোঁজ হওয়ার পর গুরুত্ব দিয়ে খোঁজ করা হলে আমরা হয়তো গুলশানের ঘটনা এড়াতে পারতাম।’
গত বছরের মার্চে কুমিল্লার চান্দিনায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া আহমেদ ইমতিয়াজ অমির বাবা কবির আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘চেয়েছিলাম ছেলেটা আমার মতো আর্মি অফিসার হবে। কিন্তু গৃহশিক্ষক আশিকুর রহমান জিলানীর মাধ্যমে আমার ছেলেটা ভুল পথে গিয়েছিল। আমরা চাই, আর কোনও ছেলেমেয়ে যেন জঙ্গিবাদের ভুল পথে না যায়। যারা গিয়েছে তারা ফিরে এলে, তাদের ভুল বুঝতে পারলে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা উচিত। এই ব্যবস্থা দৃশ্যমান করতে হবে, যেন অন্যরা তা দেখে ভুল পথ থেকে ফিরে আসে।’


বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের কাছে তরুণ যোদ্ধা পাঠানোর অভিযোগ ছিল যার বিরুদ্ধে, সেই আমিনুল ইসলাম বেগও তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে সহায়তা করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বেশ কয়েকমাস থাকার পর জামিনে রয়েছেন।  তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবার ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, পরিবারের বন্ধন কম। তরুণরা কাছে পায় বন্ধুদের। তরুণরা প্রথম জঙ্গিবাদের দাওয়াত পায় বন্ধুদের কাছ থেকেই।’

আমিনুল ইসলাম বেগ বলেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে কাজ করি এখন। শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় দেখছি যে ইসলাম ধর্ম বা নৈতিক শিক্ষার চ্যাপ্টারে টেরোরিজম যে ভ্রান্ত পথ তা যুক্ত আছে। কিন্তু একজন শিক্ষক তা কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে পড়াচ্ছেন, সেটা একটি বড় বিষয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি বড় বিষয়। কারণ এখানে বিভিন্ন ধরনের লোকজনের সঙ্গে মিশতে হয়। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিতে হবে।’

ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের দিয়ে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে যে প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, তার জন্য সিটিটিসির সঙ্গে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে পরিবার থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী বা সোসাইটির একটি দায়িত্ব রয়েছে। কেউ খারাপ ছেলে না। কিন্তু এদের ভুল বোঝানো হয়েছে। মিসগাইড করানো হয়েছে। সেই বিষয়টা মাথায় রেখে পরিবার ও সোসাইটিকে কাজ করতে হবে।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে মারা গেছে, আমরা তাদের ফেরত আনতে পারবো না। যারা ভুল বুঝতে পেরেছে,  অপরাধ অনুযায়ী তাদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ যেন হয়, সেজন্য সহযোগিতা করবো। আর আমাদের আরেকটি মূল উদ্দেশ্য হলো, নতুন কোনও বাবা-মাকে যেন এখানে আসতে না হয়। আমাদের দেশকে রক্ষার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’ 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আফগানদের বিশ্বকাপ দলে ৬ অলরাউন্ডার 
আফগানদের বিশ্বকাপ দলে ৬ অলরাউন্ডার 
কাজের সন্ধানে বেরিয়ে সড়কে প্রাণ গেলো শ্রমিকের
কাজের সন্ধানে বেরিয়ে সড়কে প্রাণ গেলো শ্রমিকের
৮ ঘণ্টা শ্রম ৮ ঘণ্টা বিনোদন ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম কোথায়
৮ ঘণ্টা শ্রম ৮ ঘণ্টা বিনোদন ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম কোথায়
পাকিস্তানের বোধোদয় এবং বিএনপির ‘গোস্বা’!
পাকিস্তানের বোধোদয় এবং বিএনপির ‘গোস্বা’!
সর্বাধিক পঠিত
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সাতক্ষীরার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড 
সাতক্ষীরার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড 
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!