X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা দূর করতে দরকার সমন্বিত উদ্যোগ

তাসকিনা ইয়াসমিন
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০৭:৫৪আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৪:৫৩

চিকিৎসা বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা দূর করতে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। উন্নত বিশ্বে যে কেউ রোগাক্রান্ত হলে পারিবারিক চিকিৎসকের (ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান) দ্বারা সমস্যা চিহ্নিত হওয়ার পর তার যে ধরনের চিকিৎসক প্রয়োজন তেমন বিশেষজ্ঞের কাছে রোগীকে পাঠানো হয়। এই বিষয়টিকে বলা হয় সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। আর এর সঙ্গে যুক্ত থাকে দেশটির পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা। বাংলাদেশে এ ধরনের চর্চা এখনও হয়নি। এক দুটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে ক্ষুদ্র পরিসরে সমন্বিত পদ্ধতিতে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার চেষ্টা করলেও নেই সরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ। ফলে রোগীরা যেমন জানেন না কোন চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি সহজেই সঠিক চিকিৎসা পাবেন, তেমনই স্বল্প সময়ে বেশি রোগী আসায় তাদের ঠিকমতো চিকিৎসা বা ব্যবস্থাপত্র দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, এটা চিকিৎসকরাও স্বীকার করছেন। এ পরিস্থিতিতে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা দিতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারে মত দিয়েছেন চিকিৎসা সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগে কাশির সমস্যায় চিকিৎসা নিতে আসেন আশরাফুল ইসলাম (৭০) নামের এক রোগী। টিকেট কেটে অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি। কিন্তু সেখানে রোগীদের ভিড়ের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা তার জন্য কষ্টকর। টানা দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর চিকিৎসকের দেখা পান তিনি। চিকিৎসক রোগ সম্পর্কে জেনে পরামর্শপত্রে ওষুধ লিখে দেন।

আশরাফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসক যেভাবে রোগী দেখেন তাতে আমার মতো রোগীকে ভালোভাবে দেখা হয় না। আমাদের মতো গরিব মানুষের পক্ষে এক হাজার টাকা ভিজিট দিয়ে বেসরকারিভাবে চিকিৎসা করানো কষ্টকর। আর আমি সেটা করাতেও চাই না।’  

সম্প্রতি নিজের পায়ের ব্যথার সমস্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর বহির্বিভাগে আসেন রুবিনা আক্তার। পরে তাকে অর্থপেডিক সার্জারি বিভাগে পাঠানো হয়। প্রথম দিন চিকিৎসক তাকে এক্সরে এবং রক্ত পরীক্ষা করতে বলেন। সেগুলো করিয়ে নিয়ে পরের দিন একই রুমে গেলে অন্য চিকিৎসক তার রিপোর্টগুলো দেখেন। এ সময় চিকিৎসক রিপোর্টে সন্দেহজনক কিছু পাওয়ায় আবারও তাকে রক্ত পরীক্ষা করতে বলেন। রক্ত পরীক্ষা করে তিনি আবার পরদিন চিকিৎসকের কাছে জান। এদিন তৃতীয় একজন চিকিৎসক রিপোর্ট দেখে তাকে ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন।

এ বিষয়ে রুবিনা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি টানা তিনদিন ধরে গেলাম। কিন্তু প্রতিদিন যদি একই চিকিৎসককে দেখাতে পারতাম তাহলে ভালো হতো। কারণ, প্রথম চিকিৎসক যা ভেবে আমাকে রক্ত পরীক্ষা করাতে বলেছেন, দ্বিতীয় বা তৃতীয় চিকিৎসকের তা নাও মনে হতে পারে। তবে এক্সরে করার খরচ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এখানে এক্সরে করতে মাত্র ২৫০ টাকা লেগেছে, বেসরকারি হাসপাতালে সেই খরচ লাগতো ৫শ’ টাকা।’

চিকিৎসায় কোনও সুবিধা মিলেছে কিনা—জানতে চাইলে রুবিনা বলেন, ‘চিকিৎসা করে সুবিধা মিলছে। এখন পায়ের ব্যথা অনেকটা কমেছে।’

শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ বা বিএসএমএমইউ’তেই নয়, ঢাকা শহরের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিত্র এমনই। বাইরে রোগীর বিশাল লাইন।

জানা গেছে, কোথাও কোথাও মাত্র একজন চিকিৎসক সকাল আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত একটানা রোগী দেখেন। তবে কোথাও কোথাও চারজন চিকিৎসকও থাকেন। সব হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে ১০০ থেকে ৩০০ রোগী প্রতিদিন দেখা হয়। চিকিৎসকের সংখ্যা কম হওয়ায় এই বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য সুচিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে তা বড় বাধা, একইসঙ্গে চিকিৎসকের জন্য তা চ্যালেঞ্জের।

দেশের চলমান সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার এই অবস্থাকে অব্যবস্থাপনা বলে মনে করেন হেলথ রাইটস মুভমেন্ট ন্যাশনাল কমিটির প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ডা. রশীদ-ই-মাহবুব। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও হাসপাতালে আমাদের দেশের মতো বহির্বিভাগ থাকে না। একজন রোগীর প্রথমে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের কাছে যাওয়া উচিত। পরে তিনি রোগ সম্পর্কে জেনে রোগীর রোগ নির্ণয় করে ডকুমেন্ট জোগাড় করবেন। এই রোগী কোন স্পেশালিস্টের কাছে যাবে সেটা ওই ফিজিশিয়ান নির্ধারণ করবেন। তিনি স্পেশালিস্টের অ্যাপয়নমেন্ট করিয়ে দেবেন। সেই অ্যাপয়নমেন্টের তথ্য রোগীর ঠিকানায় পৌঁছে যাবে। ওই নির্ধারিত সময়ে রোগী সেখানে উপস্থিত থাকবেন। ওইদিন সমাধান না হলে পরের দিন বা তারপরের দিন চিকিৎসক রোগী দেখবেন। এটা ক্রনিক কেসের জন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যে চিকিৎসা করাবেন তার একটা ডকুমেন্ট ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানের কাছে পাঠাতে হবে। আর অ্যাকিউট কেসের ক্ষেত্রে সবসময় রোগী ইমার্জেন্সিতে যাবেন। কিন্তু আমাদের দেশে এসব প্রক্রিয়ার কিছুই নেই। আমাদের দেশের হাসপাতালগুলোতে বহির্বিভাগ বলে যা আছে তা একটা বার্ডেন (বোঝা) এবং রোগীর জন্য কার্স (অভিশাপ)।’

তিনি বলেন, ‘গাজীপুরের কালিয়াকৈরে একটি সরকারি প্রকল্পের আওতায় এখন এমন সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা খুবই ছোট পরিসরে। সমাজে যাদের ভ্যালু আছে তারা এখানে চিকিৎসাসেবা পান। কিন্তু সাধারণ মানুষ প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত থাকছেন। সূর্যের হাসি প্রকল্পটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকার কথা ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেটা আউটসোর্সিংয়ের আওতায় দিয়ে দিয়েছে। আগে ঢাকার প্রত্যেক জায়গায় একটা করে ডিসপেনসারি ছিল। সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল। ওগুলোকে পলি ক্লিনিক হিসেবে ট্রান্সফার করার কথা বলেছি। এতে করে রেডিওলজি, প্যাথলজি বিভাগ সেখানে হবে। ওখানকার স্পেশালিস্ট যাবে এবং রোগীদের চিকিৎসা দেবে। কিন্তু সরকারিভাবে এটি করা হয়নি। ফলে বাইরের যারা ফান্ডিং করে তারা তাদেরটা এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সিটি করপোরেশনের গরিব মানুষ।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলাগুলোতে অন্তত কিছু সুযোগ আছে। এখন তো উপজেলাগুলোতে হেলথ কমপ্লেক্স আছে। এখানে তো কোনও ছোট হাসপাতালও নেই। বড় হাসপাতালে গরিব মানুষ নেগলেক্ট (অবজ্ঞার শিকার) হচ্ছে। কারণ, সিরিয়াস কিছু হলে ভ্যালু আছে, ছোটখাটো হলে কোনও পাত্তাই দেয় না। এতে করে চিকিৎসক ও রোগী উভয়েরই সময় নষ্ট হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশে লিগ্যাল অ্যাডভাইজার এবং একজন চিকিৎসকের দাম সবচেয়ে বেশি। তারা সবকিছুই জানে। এখনও আমাদের দেশে এই সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। এর প্রভাব প্রত্যেক মানুষের জীবনে পড়ছে।’

এ প্রসঙ্গে বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল বলেন, ‘দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি লেভেল আছে। প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি লেভেলের রোগী স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকে যাবে। জ্বরের জন্য আমাদের এখানে কোনও রোগীর আসার দরকার নেই। একসময় আমাদের এখানে রেফার্ড ছাড়া কোনও রোগী দেখা হতো না। আউটডোর চালু হওয়ার পর থেকে সব রোগী আসতে শুরু করল। বছরে আমাদের মেডিসিন আউটডোরে চিকিৎসকদের ৮-৯ হাজার রোগী দেখতে হয়। এটা রোগীদের জন্য কষ্টকর ও চিকিৎসকদের জন্য তো লোড ( বোঝা)। আমরা চাইলে সব রোগী ফেরতও দিতে পারি না। যে রোগী দোহার থেকে এসেছে তাকে কী করে ফেরত পাঠাই? যদি এমন হয় যে চাঁদপুরের রোগীর চিকিৎসা চাঁদপুরেই হবে। খুব বেশি প্রয়োজন পড়লে তিনি কুমিল্লা হাসপাতালে আসবেন। তাহলে আমাদের ওপর রোগীর চাপ কমবে।’

তিনি বলেন, ‘সবাই হাসপাতালের নেগেটিভটাই দেখে। হাসপাতাল যে রোগীর এত চাপ সামলায় সেটা দেখে না।’

ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. এহ্সানুল করিম বলেন, ‘নগর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন করতে চাইলে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে সরকারি ডিসপেনসারি থাকতে হবে। মাল্টিপারপাস হেলথ ওয়ার্কার রাখা প্রয়োজন, যেন বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা তথ্য নিতে পারেন।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা দুই ধাপে নতুন ১০ হাজার চিকিৎসকের পদ তৈরি করছি। দুইটা স্পেশাল বিসিএস হবে। সেই বিসিএস-এর জন্য এখন প্রস্তুতি চলছে। তাদের মধ্যে ৫০০ জন থাকবে বিডিএস (সহকারী ডেন্টাল সার্জন)। তখন বিভিন্ন স্থানে থাকা চিকিৎসকদের পদগুলো পূরণ করা সম্ভব হবে।’

 

/এসএনএইচ/টিএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: ঝরে গেলো আরেকটি প্রাণ
ভাসানটেকে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: ঝরে গেলো আরেকটি প্রাণ
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী