দুই মাস সাধারণ ছুটি শেষে উন্মুক্ত ১৫ দিনেও লকডাউনের ধকল কাটাতে পারেনি শ্রমজীবী মানুষ। জীবন-জীবিকার তাগিদে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে তারা ছুটছে। কেউ কেউ অপ্রয়োজনেও ছুটছে। বিনোদন কেন্দ্র ও পার্ক বন্ধ থাকলেও মানুষ উন্মুক্ত স্থানে প্রতিনিয়ত আড্ডা দিচ্ছে। সংক্রমণ ধরা পড়ার পর মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি এই ১৯ দিনে হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে লকডাউন করা হয়। অবশ্য সরকারিভাবে এটিকে ‘সাধারণ ছুটি’ বলা হয়েছে। পরে জীবন-জীবিকার জন্য ৩১ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবকিছু পরিচালনা করার নির্দেশনা দেয় সরকার। মূলত জুনের ১ তারিখ থেকে মানুষ করোনা পরিস্থিতিতে বাধাহীনভাবে জীবিকার সন্ধানে নেমেছে। যদিও রাজধানীতে স্বাস্থ্যবিধি না মানার জন্য কখনও কখনও মোবাইল কোর্ট শাস্তি দিয়ে থাকে, তবে সেই প্রক্রিয়া মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে যথেষ্ট নয় বলে ইতোমধ্যে প্রমাণিত। এই প্রতিবেদনে লকডাউন ছাড়া জুনের প্রথম ১৯ দিনের চিত্র দেখানো হবে।
জীবন-জীবিকার তাড়না ছাড়াও চলছে অপ্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ার প্রতিযোগিতা
লকডাউনের সময়ে শুধু দৈনিক রোজগার করা মানুষরাই নয়, স্বল্প আয়ের মাসিক বেতনভুক্তদের আয়ের পথও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই মানুষরা সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা নিয়ে কিছুদিন চললেও তা দুই মাসের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। তাই লকডাউনের মধ্যেও নিম্নআয়ের মানুষ বের হয়েছে। এক্ষেত্রে তারা মোটেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারেনি। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর মোড়ে কথা হয় রিকশাচালক জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তিনিসহ নয় জন রিকশাচালক যাত্রী বহনের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। কারও মুখে মাস্ক নেই। একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে ও বসে কথা বলছেন তারা। এরকম চিত্র রাজধানীজুড়েই। এসব খেটে খাওয়া মানুষ পেটের দায়ে বের হন। কিন্তু জীবিকার তাগিদের বাইরেও রাজধানীর উন্মুক্ত স্থান হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেকসহ বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য মানুষকে আড্ডা দিতে দেখা গেছে এই ১৫ দিন। অনেকে হাতিরঝিলে গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে জন্মদিনের পার্টিও করে।
স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কেউ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অধিকতর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত স্বাস্থ্যবিধি সাধারণ মানুষসহ সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধীনস্থ দফতর ও প্রতিষ্ঠানসহ সব সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে পালনের জন্য অনুরোধ করা হলেও তা পুরোপুরি মানা হচ্ছে না কোথাও। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয়েও তা মানা হচ্ছে না। সেখানে অনেকটাই উপেক্ষিত সরকারের দেওয়া ১২ নির্দেশনা। রাজধানীর ব্যস্ত কাঁচাবাজার কাওরানবাজারের খুচরা বিক্রেতাদের হলি ক্রস কলেজের সামনের সড়কে নিলেও সেখানে কোনও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। গায়ে গায়ে মানুষ দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করছে। সবজি বিক্রেতা রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি সবকিছু মেনে চলতে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব করলে দোকানের সামনে মানুষের ভিড় লেগে যায়। রাস্তা ব্লক হয়ে যায়। তাই দ্রুত চেষ্টা করি ক্রেতাদের বিদায় করার।’
সবকিছুর মতো রাজধানীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন দোকান, শপিং মল খুলে দেওয়া হয়েছে। এসব জায়গাতেও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী আসতে পারছে না। সকালে রাজধানীর বাসগুলোতেও থাকে যাত্রীদের চাপ, আসন খালি রেখে সকালে মিনিবাস চলতে পারছে না।
রঙের লকডাউন
গত ১ জুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনুযায়ী লাল, হলুদ ও সবুজ এই তিন জোনে পুরো দেশ ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। যেসব এলাকায় করোনার সংক্রমণ বেশি সেসব এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কম আক্রান্ত এলাকা হলুদ এবং আক্রান্ত হয়নি এমন এলাকা সবুজ জোন হিসেবে বিবেচিত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী ঢাকায় ৩৮টি এলাকা রেড জোন চিহ্নিত। প্রাথমিকভাবে পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন করা হয়েছে। তবে পূর্ব রাজাবার থেকে বিভিন্ন অজুহাতে মানুষ বের হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সংকটের কারণে এই রঙ নির্দেশক তত্ত্বের লকডাউন পুরোদমে শুরু হয়নি। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ও করোনা প্রতিরোধে গঠিত কেন্দ্রীয় টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য সচিব ডা. জহিরুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, গত ১১ জুন কেন্দ্রীয় টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৪ দিনে প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার ভেতরে ৬০ জন রোগী থাকার ভিত্তিতে এই রেড জোন ঘোষণা করা হচ্ছে। এটা কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য প্রযোজ্য। বাকি জেলাগুলোতে ১৪ দিনের ভেতরে ১ লাখ জনসংখ্যার ১০ জন থাকলে সেটাকে রেড জোন ঘোষণা করা হবে।
তিন মাসের মোট আক্রান্ত ও মৃত্যু অর্ধেকের বেশি এই ১৯ দিনে
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর ১৮ মার্চ প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ৩১ মে থেকে সাধারণ ছুটি বাতিল হয়। লকডাইন শিথিল করা হয়। ৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত প্রায় তিন মাসে সারাদেশে মোট আক্রান্ত রোগী ছিল ৪৭ হাজার ১৫৬ জন এবং ১ জুন থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত রোগীর সংখ্যা ৫৮ হাজার ৩৮২ জন। এই দুই সময়ের মধ্যে মৃত্যুর পার্থক্য অর্ধেকের বেশি। লকডাউন বা সাধারণ ছুটির মধ্যে অর্থাৎ ৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মারা গেছেন ৬৫০ জন। অন্যদিকে, ১ জুন থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত মারা গেছেন ৭৩৮ জন।
৮ মার্চ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত সব মিলিয়ে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ ৫ হাজার ৫৩৫ জন। আর মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৩৮৮ জনের। এ সময়ে সুস্থ হয়েছেন ৪২ হাজার ৯৪৫ জন।
নিরাশার কথা স্বাস্থ্য অধিদফতরে
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশের করোনাভাইরাস আগামী এক-দুই বা তিন মাসে যাবে না। এটি দুই থেকে তিন বছর বা তার চেয়েও বেশি স্থায়ী হবে। যদিও সংক্রমণের মাত্রা উচ্চহারে নাও থাকতে পারে। আর সেজন্য সরকারের নেওয়া পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। করোনামুক্ত হয়ে বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) কোভিড-১৯ নিয়ে আয়োজিত নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে অংশ নিয়ে তিনি এ পরিকল্পনার কথা জানান।
ছবি : সাজ্জাদ হোসেন